ওয়েনাড় থেকে লেখা চিঠি

ওয়েনাড় থেকে লেখা চিঠি
Spread the love

সুমন ভট্টাচার্য

শ্রীচরণেষু বাবা,

“এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে”

অনেক ছোটবেলায় যেদিন রাত্রিবেলা বাড়িতে এসে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ওই লাইনটা আবৃত্তি করেছিলেন, সেদিন আমি মানে বুঝতে পারিনি। তবু বলেছিলেন, “আরও বড় হয়ে যখন তুই এমন কোথাও যাবি যেখানে আকাশের মেঘ এসে তোর আশেপাশে ঘুরে বেড়াবে, সেই দিন এই লাইনটার মানে বুঝতে পারবি।” ওয়েনাড়ে এসে, কর্ণাটক কেরালার সীমান্তের সবুজ, আরও সবুজ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে, পশ্চিমঘাট পাহাড়ে মেঘের টোকা মেরে যাওয়া দেখতে দেখতে প্রায় চার যুগ আগে কবির স্বকণ্ঠে শোনা লাইনটা মনে পড়ে গেল। সত্যিই তো কর্ণাটকের কুর্গ বা কেরালার ওয়েনাড়ে এলে একপাশে মেঘ খেলা করে বেড়ায়।

আমাদের কৈশোরে যাঁর সিনেমা সাবালক হতে শিখিয়েছিল, রোমান্সের প্রথম পাঠ দিয়েছিল, সেই ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’-এর পরিচালক, আমির খানের তুতো ভাই মনসুর খান নাকি কুর্গে এসে আর মুম্বাইয়ের কংক্রিটের পৃথিবীতে ফিরে যেতে রাজি হননি। ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ বা ‘যো জিতা ওহি সিকান্দার’-এর মতো ব্লকব্লাস্টার ছবির পরিচালক বলিউডের জীবনকে টাটা করে কুর্গের কফি বাগানের বাংলোতেই বাকি জীবনটা কাটাচ্ছেন। শোনা যায়, সিনেমা থেকে ছুটি নিলে আমির খান তাঁর জীবনের প্রিয় নারীকে নিয়ে দাদা মনসুর খানের বাংলোতেই ছুটি কাটাতে চলে আসেন। কুর্গ
কিংবা ওয়েনাড়ে সন্ধে নামতে যাঁরা দেখেছেন, কফির কাপ হাতে নিয়ে সামনের কফির বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকার ভাগ্য যাঁদের হয়েছে, তাঁরা সত্যিই ভাগ্যবান। কফির মধ্যে দিয়ে যে প্যাশন বয়ে যায়, কিংবা অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিতে যে ক্ষরণ হয়, তা কি শুধু নেটফ্লিক্সে কলম্বিয়ার ওয়েব সিরিজ দেখলে মালুম হবে! কফির সঙ্গে প্যাশন শব্দটা কতটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে, তা পশ্চিমঘাট পর্বতশ্রেণীর মধ্যে থাকা এইসব উপত্যকায় এলেই ভালো উপলব্ধি করা যায়।

ওয়েনাড় যে কারণেই বিখ্যাত হোক, বাবা, এই শহরে আসার জন্য তোমার অন্য যে কারণই থাকুক, আমি নিশ্চিত একবার এই সবুজের রাজ্যে পৌঁছে গেলে তুমিও অন্য সব কথা ভুলে যেতে। অন্য সব ‘অনুষঙ্গ’কে কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে রেখে পাহাড়ের কোলে তৈরি কোনও বাংলোয় বসে চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে থাকতে। মনে আছে ছোটবেলায় একবার মুম্বাই থেকে ট্রেনে গোয়া যাওয়ার সময় ভোরবেলা ট্রেনের জানলা দিয়ে জলপ্রপাত দেখতে তুমি আমাদের বাধ্য করেছিলে। অনেক পরে যখন কোঙ্কণ রেলওয়ে দিয়ে যাওয়াটা ‘প্যাশন’ হয়ে গেল, তখনও আমি একবার ওই ট্রেনে চড়ে গোয়া গিয়েছি আবার শুধু ঝরনাটাকে দেখব বলে। আর এখানে ওই ওয়েনাড়ে কত যে ঝরনা, পাহাড়ের প্রতিটি বাঁকে কতটা বিস্ময় অপেক্ষা করে থাকে তা কী করে তোমাকে বলে বোঝাব বলো!

অনেক দিন আগে একবার টানা দুই সপ্তাহ কন্যাকুমারীকায় কাটিয়ে ত্রিবান্দ্রমে (অধুনা তিরুবন্তপুরম) এসে রেল স্টেশনেই বিরিয়ানি খেতে নিয়ে গিয়ে তুমি বলেছিলে, “আরে মালাবারের বিরিয়ানি না খেলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের বিরিয়ানি সম্পর্কে জানবি কী করে?” ওয়েনাড়ে এলে মালুম হয় সত্যিই মালাবারের বিরিয়ানি কতটা আলাদা, স্বাদের দিক থেকে কতটা চমকপ্রদ! তুমি তো জানোই চিংড়ি আমার চিরকালের ফেভারিট। ওয়েনাড়ে এসে কেউ যদি চিংড়ির মালাইকারী না খায়, তাঁর জীবনই বৃথা। এমনিতেই এখানে বিভিন্ন রান্নায়, অবশ্যই আমার ফেভারিট বিভিন্ন মাছের পদে নারকেলের ব্যবহার অন্যধরনের উপলব্ধি দেয়। কিন্তু চিংড়ির মালাইকারী বা চালের তৈরি প্যান কেকের ভেতরে চিংড়ি রেখে সেঁকে দেওয়া যে পদ, তা একেবারেই আলাদা উপলব্ধি। ওয়েনাড় তাই বারবার টানে, ফিরে আসতে বলে তার বিভিন্ন মাছের পদের জন্য, সন্ধে নামার আগে গোধূলিতে কফি বাগানে হারিয়ে যাওয়ার জন্য কিংবা ঝরনার পাড়ে বসে হৃদয়ের শব্দ শোনার উপলব্ধিকে টাটকা রাখার কারণে।


Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *