ঘরের কাছেই আন্দামান ! বালুগাঁও

ঘরের কাছেই আন্দামান ! বালুগাঁও
Spread the love

লেখা ও ছবি- বোধিসত্ত্ব রায়

কাইপাড়া পেরিয়ে আসার পর থেকে প্রকৃতি ক্রমে নির্জন হয়ে এল। লোকালয়ের দেখা নেই। ঘন বন আর পাহাড় চলেছে রেললাইনের দু’ পাশ ঘিরে। মাঝে মধ্যে দু’ চার ঘর বসতি আছে। তাও ফাঁকা ফাঁকা। জঙ্গলে মাঝে মাঝেই দুমড়ে মুচড়ে পড়ে থাকা গাছ-গাছালি দেখিয়ে মেহুলি বলল, ফাইলিন? বললাম, মনে হয় তাই। আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ওদিকের জানলার বৃদ্ধ বললেন, যাচ্ছেন তো বালুগাঁও? সেদিকে আরও বেশি খারাপ অবস্থা। আমার তো গোপালপুরে উট চলে। রেগুলার যাই। ঘর বাড়ি গাছপালা কিছুই আস্ত নেই আর! অবাক গলায় বললাম, আরে আপনি বাংলা জানেন দেখছি। বৃদ্ধ হেসে বললেন, হ্যাঁ। ওড়িয়া, বাংলা সব জানি। এখানে চল্লিশ সাল উটের বিজনেস করছি। আমার বাড়ি রাজস্থানের রামদেওরায়। নাম শুনেছেন?
বললাম, হ্যাঁ পোখরানের কাছে তো? জয়সলমির রুট। বৃদ্ধ খুশির সুরে বলে উঠলেন, হ্যাঁ বাবু। আমাদের তো শুখার দেশ। খালি বালি। তাই আমরা এদিকে চলে এলাম। বিশ হাজারে একটা উট কিনি। আনতে খরচ আর দশ। বিক্রি হয়ে যায় এক লাখে।

আমাদের কথার মাঝখানে মেহুলি বলে উঠল, দেখ কত লাল শালুক আর পাখি। ওই যে! জানলার বাইরে টলটলে জলের ঝিল। তার কাকচোখ জলে ফুটে আছে লাখে লাখ লাল শালুক। আর ওই শালুক বনে চলেছে হাজারে হাজারে পরিযায়ী পাখির ওড়াউড়ি। বিলের ঠিক পিছন থেকে উঁচিয়ে আছে নীলচে রঙের ধুম পাহাড়। অবশেষে বালুগাঁও। রোদ্দুর তখন মাথার উপরে। হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন স্থানীয় যাত্রী ছাড়া টুরিস্ট কেবল আমরাই। শুনসান ঝকঝকে স্টেশনের ঠিক পিছনটা জুড়ে দাঁড়িয়ে প্রকাণ্ড দুই পাহাড় চূড়া। শুনলাম স্থানীয় নাম ‘মামা-ভাগ্নে পাহাড়’। স্টেশনেই আলাপ হয়ে গেল নৈহাটির নিত্যানন্দর সঙ্গে। সে অটো চালায়। তার বাপ-কাকারা বালুগাঁও এসেছিল মাছ ধরার পেশায়। আর ফিরে যায়নি। চিলিকার পাশেই তাদের বাড়ি। নৈহাটি এখন তাদের পরদেশ।

বালুগাঁওয়ের ফেরিঘাট যাওয়ার পথে সে কথায় কথায় বলল, আজ পঙ্কুকি তিথি বলে লোকজন পাবেন ফেরিঘাটে। নইলে রিজার্ভ বোটে যেতে হয়। মেহুলি আমাকে জিজ্ঞাসা করল, হ্যাঁগো পঞ্চুকি কী? বললাম, বাংলায় কার্তিক পুজো যেটা। নিত্যানন্দ আমার কথায় সায় দিয়ে বলল, এই পুজোটা ওড়িশায় খুব ধুমধাম করে হয়। এক মাস সবাই নিরামিষ খায়। ছোট বাজারের মধ্যে দিয়ে বালুগাঁও ফেরিঘাট পর্যন্ত নিয়ে এল নিত্যানন্দ। অটো থেকে নামতেই সাগর ছুঁয়ে আসা চিলিকার নোনা বাতাসের ঝাপটা লাগল চোখেমুখে। তিন দিকে মাথা তুলে পূর্বঘাট পর্বতমালা। সামনে দিগন্ত জোড়া মায়াবি চিলিকার সবজে নীল জল বিস্তার। সেই নীলের অতল ফুঁড়েও মাথা উচিয়ে সারি সারি ছোট বড় টিলা। নিত্যানন্দ বলল, দাদা এখানে সরকারি ফেরি নেই। সামনে ওই যে বালুগাঁও ফেরি সার্ভিসের ইউনিয়ন অফিস। গিয়ে টিকিট করে নিন।

বালুগাঁও বোট সার্ভিস ইউনিয়ন। শ্যাওলা ধরা সাইনবোর্ডটায় অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। খানিকটা জায়গা বাঁশ দিয়ে ঘিরে ইউনিয়নের টিকিট কাউন্টার। উপরে ত্রিপলের ছাউনি। চিলিকার বুক থেকে উঠে আসা দস্হা ওয়ায় সেটা ছাউনি কম, বরং পতাকার মতো পতপতিয়ে উড়ছে বেশি। টিকিট দেওয়ার টেবিলের চার পাশে রীতিমতো ঠেলাঠেলি ভিড়। গুঁতোগুতি করে সেই পর্যন্ত পৌঁছবার পর জানলাম, এদিন দুটো পয়েন্টে কোনও ফেরি যাচ্ছে না। কারণ, ভরা পূর্ণিমার উত্তাল সাগর। বাকি তিনটেয় যাওয়া সম্ভব। কিন্তু তাতে সময় লাগবে সাকুল্যে চার ঘণ্টা। মেহুলিকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী করব? সে বলল, কেবল কালীজাই আইল্যান্ড চলো। টিকিট কিনে ফেরিঘাটে এলাম। টিকিট বাবু বলেছে, বোট ভিড়লেই নাম ধরে ঢেকে নেওয়া হবে। ফেরিঘাটের দু’ ধারে হরেক কিসিমের খাবারের টেম্পোরারি স্টল। সামুদ্রিক মাছ ভাজার দোকানের বাড়বাড়ন্ত। সিঙাড়া কচুরি মিষ্টির দোকানের সঙ্গে গা লাগোয়া ইডলি-ধোসার দোকানও আছে। মেহুলি বায়না ধরল ইডলি খাবে। কয়েকজন সাইকেলে হাঁড়ি ঝুলিয়েও ইডলি-ধোসা বিক্রি করছে হেঁকে হেঁকে। একটা দোকান থেকে গরম ইডলি দু’ প্লেট কিনলাম। সঙ্গে দিল ডাল আর চাটনি। ফুঁ দিয়ে গরম ইডলি খেতে খেতে মেঘলি বলল, উ-ম-ম কী দারুণ বানিয়েছে গো! বললাম, এখন আর কিছু খাওয়া যাবে না। টানা ষোলো কিলোমিটার চিলিকায় ভাসতে হবে। সাগর যা উত্তাল। তাতে সি-সিকনেস হলে আর দেখতে হবে না!
 
বোট বলতে, কোনও মতে ভাসা ভটভটি নৌকা। আমরা পনেরো জন যাত্রী। মিনিট দশেক চলতেই বালুগাঁওয়ের ফেরিঘাট আবছা হয়ে এল। বাঁ দিকে জেগে উঠল ‘মামা-ভাগ্নে’ পাহাড়। পিছনে নীলচে বেগুনি ইস্টার্নঘাট রেঞ্জ। জলেরও তিন বর্ণ। গাঢ় নীল, সবজে নীল আর দূরে খোলা সাগরের দিকটা ভয় ধরানো কালচে নীল। দূরে দূরে ভাসছে ফেরিবোট, জেলেনৌকা গুলো। উড়ো খইয়ের মতো আতিপাতি উড়ছে দলে দলে সি-গাল।

হাওয়ার বেগ ক্রমে বাড়তে শুরু করল। ঢেউগুলো আপাতনিরীহ চেহারা ছেড়ে মাখায় সাদা ফেনার মুকুট পরে ছুটে আসতে থাকল বোটের দিকে। যেন বিষাক্ত ছোবলে বোটটাকে ডুবিয়ে দিতে পারলেই তাদের সুখ। ঝলকে ঝলকে নোনা জলের ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দিল সমস্ত শরীর। ওড়িয়া সহযাত্রীরা আর্তনাদের সুরে বলে উঠল, রক্ষে করো মা কালীজাই!…
 
চিলিকার সাগর মুখটা পেরিয়ে আসার পর জলের রংবদল হল। উত্তাল ঢেউয়ের দাপটও কিছুটা সহনীয় হল। মেহুলি বলল, ওই-ই যে দেখ! ওই তো মন্দিরের চূড়ো দেখা যাচ্ছে! সবজে নীল সাগরমুখী অতল জলের রাজ্যে মাথা তুলে এক পাথুরে দ্বীপ।মাঝদুপুরেও হালকা ধোঁয়ার আস্তরে ঢাকা। তবু বোঝা যাচ্ছে দ্বীপটা সবুজে সবুজে একাকার। এক পাশে নোনা জল ছুঁয়ে মা কালীজাই টেম্পল। দু’ চূড়ো মন্দিরের মাথায় উড়ছে দুটো পতাকা। বোট তীরে পৌঁছতেই সবাই হুড়মুড়িয়ে নেমে
পড়ল। মেহুলিও স্বস্তির শ্বাস নিয়ে বলল, বাপরে এটা রীতিমতো অ্যাডভেঞ্চার গো!

কথা ঘোরানোর জন্য বললাম, জানো পারিকুদ রাজারা এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। শীতের সময় দ্বীপটা পুরো জেগে ওঠে। আর অন্যান্য সময় অর্ধেকটা জলের নীচে ডুবে থাকে। মকরসংক্রান্তি আর রাজা সংক্রান্তির সময় এখানে বড় মেলা হয়। মা কালীজাই হলেন জেলে সম্প্রদায়ের দেবী। চিলিকার মেছোরা সব মা কালীজাইয়ের উপাসক। মেহুলি পুজো দিতে মন্দিরে ঢুকল। আর পাঁচটা ওড়িয়া গড়নের মন্দিরের সঙ্গে এই মন্দিরের স্থাপত্যে মিল বিশেষ নেই। আসপাশে ফুল, মালা, ধূপের বাজার গমগমে। রয়েছে নানা রকম খাবারের দোকানও। তবে আমিষ খাবার পাওয়া যায় না। মন্দিরের পিছনে পাহাড় আর ঘন বন। বড় বড় পাথরের উপরে আছড়ে পড়ছে চিলিকার নীলচে সবুজ ঢেউ। মেহুলি বলল, যেন ঘরের পাশে আর এক আন্দামান। বললাম, না বলে দিলে, ছবি দেখলে সত্যি মনে হবে গ্রেট নিকোবরের কোনও দ্বীপে এসেছি।

গোটা দ্বীপটাকে ঘিরেই সিমেন্টের পথ আছে। গাছের ডালে ডালে অচেনা পাখির ডাকাডাকিতে কান পাতা দায়। হঠাৎ একটা অর্জুন গাছের নীচে দেখা মিলল বনময়ূরীর। আমাদের দিকে কটমটিয়ে খানিক তাকিয়ে থেকে হেলেদুলে গভীর বনে ঢুকে গেল। পায়ে হেঁটে গোটা দ্বীপটা এক চক্কর দিলাম। সূর্য তখন অনেকটা নেমে এসেছে পাহাড় চূড়ার কাছাকাছি। এবার ফেরার পালা।
 
পাক্কা এক ঘণ্টা জলে ভেসে বালুগাঁও ফেরা গেল। তবে এবার ঢেউয়ের দাপাদাপি আগের চেয়ে কম। মাঝিরা বলল, তখন জোয়ার ছিল। তায় ভরা কোটালের টান। ফেরিঘাট ছেড়ে বাজারের দিকে এসে ভাতের হোটেলে ঢুকে পড়লাম। ষাট টাকায় দু’ রকম সবজি, ডাল আর পাঁচ টুকরো চিকেন। শেষ পাতে লেবুর আচার। সস্তা তো বটেই। তবে রান্নায় সাউথ ইন্ডিয়ান স্টাইলটা মেহুলির না-পসন্দ। সে বিশেষ খেলো না। বলল, তুমি খাও। ততক্ষণ কিছু মাছ, ক্র্যাবস ফ্রাই করিয়ে নিই। ট্রেনে বসে খাব।
 
অটো স্টান্ডের পাশে শুঁটকি মাছের সারি সারি দোকান। চার পাঁচ কেজি ওজনের মাছও বেমালুম শুঁটকি হয়ে শুয়ে আছে ঝুড়িতে। রয়েছে মাছের ডিমের শুঁটকিও। অটো ভাড়া নিলাম। স্টেশন অব্দি পঞ্চাশ টাকা। ছোট্ট মেছো শহরটায় তখন একটু একটু করে অন্ধকার নামছে। মেহুলি কোল ঘেঁষে এল। বলল, যদি বোট ডুবে যেত কী করতে তুমি? মুচকি হেসে বললাম, ভাবছিলাম কোনও ভাবে ক্যামেরাটা বাঁচাতে হবে! মেহুলি ফোঁস করে বল্লে, আর আমি? ফের মজা করতে গিয়েও থমকে গেলাম। ছলছলে চোখে সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখের দিকে। বললাম, একথার উত্তরটা তুমি জানো!


কীভাবে যাবেনঃ

পুরী থেকে বালুগাঁও ১০০ কিমি। আড়াই ঘণ্টার পথ। হাওড়া থেকে সাউথ ইন্ডিয়ার দিকে যাওয়া সব ট্রেনই বালুগাঁও হয়ে যায়। পুরী এসে একদিন বালুগাঁও আসার প্ল্যান করতে পারেন। সরাসরি ট্রেন আছে। ট্রেনে ভায়া ভদ্রক হয়েও বালুগাঁও পৌঁছনো যায়।


Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *