শের-এ-বাংলা : বাঙালি রাজনীতির বাতিঘর

শের-এ-বাংলা : বাঙালি রাজনীতির বাতিঘর
Spread the love

২৭ এপ্রিল। ১৯৬২ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির এক অবিসংবাদিত নেতা মৃত্যুবরণ করেন। সেই মহান নেতার বিদেহী আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি বাঙালিনামায়, বাংলাদেশের বিশিষ্ট সমাজকর্মী এবং ফজলুল হক-এর নাতবৌ সালমা ফাইয়াজ -এর লেখায়।

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বাঙালি জাতির আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন। এই মহান নেতা এদেশের গরিব-দুখী মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সারাজীবন তিনি কাজ করে গেছেন। তিনি অসম্ভব মেধাবী একজন মানুষ ছিলেন। ছাত্রজীনে তিনি তাঁর কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। এ কে ফজলুল হক ঝালকাঠীর রাজাপুর থানার সাতুড়িয়া গ্রামে মিঞাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি পৈতৃক নিবাস পটুয়াখালীর বাউফলে। বরিশাল জেলা স্কুল, কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন তিনি। ১৮৯১ সালে কলকতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এফএ পাস করার পর তিনি গণিত, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা এ তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ প্রথম শ্রেণিতে বিএ পাস করেন। বিএ পাস করার পর এমএ ক্লাসে প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন ইংরেজি ভাষায়। পরীক্ষার মাত্র ছয় মাস আগে তাকে এক বন্ধু ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন যে, মুসলমান ছাত্ররা অঙ্ক নিয়ে পড়ে না, কারণ তারা মেধাবী নয়। এই কথা শুনে তাঁর জেদ চড়ে যায়। তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, অঙ্কশাস্ত্রেই পরীক্ষা দেবেন। এরপর, মাত্র ছয় মাস অঙ্ক পড়েই তিনি প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। তিনি দাবা খেলতে ও সাঁতার কাটতে পছন্দ করতেন। বৃহত্তর বরিশালে তাঁর বাবা ছিলেন প্রথম গ্রাজুয়েট আর তিনি ছিলেন দ্বিতীয় গ্রাজুয়েট। সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি এ দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য
রাজনীতিতে নামেন। তিনি বরিশাল পৌরসভার কমিশনার পদে বিপুল ভোটের ব্যবধানে সদস্য নির্বাচিত হন। এভাবেই তার রাজনীতি শুরু। ১৯১৩ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে এ কে ফজলুল হক বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

শের-এ-বাংলা ১৯১৬ সালে মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। পরের বছর ১৯১৭ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এর সাধারণ সম্পাদক হন । তিনিই ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি যিনি একই সময়ে মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট এবং কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯১৮-১৯ সালে জওহরলাল নেহেরু ছিলেন ফজলুল হকের ব্যক্তিগত সচিব। ১৯৩৭-এর নির্বাচনে শেরে বাংলা ঘোষণা দিয়েছেন নির্বাচনে জিতলে তিনি জমিদারি প্রথা চিরতরে উচ্ছেদ করবেন। তিনি যাতে নির্বাচিত হতে না পারেন তার জন্য সারা বাংলাদেশ আর কলকাতার জমিদাররা একত্র হয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেছেন। কৃষকরা কিন্তু তাঁদের নেতাকেই ভোট দিয়েছেন। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার বিল, মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের জন্য বাংলার গভর্নরের কাছ থেকে বৃত্তি ও আর্থিক সাহায্য, মুসলিম এডুকেশন ফান্ড গঠন, মাধ্যমিক শিক্ষা বিল উত্থাপন, বরিশালে চাখার কলেজ, আদিনা কলেজ, মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজ প্রতিষ্ঠা, নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য কলকাতায় লেডি ব্রেবোন কলেজ ও ঢাকায় ইডেন কলেজ প্রতিষ্ঠা, কলকাতার বেকার হোস্টেল (যেখানে থেকে বঙ্গবন্ধু লেখাপড়া করেছেন) কারমাইকেল হোস্টেল এবং ফজলুল হক মুসলিম হল প্রতিষ্ঠাসহ শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রসারে অগ্রণী
ভূমিকা পালন করেন এই মহান নেতা। বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয়দফা ১৯৪০ সালের এ কে ফজলুল হকেরলাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই প্রণয়ন করা হয়। ১৯৪০ সালের ২২-২৪ মার্চ লাহোরের ইকবাল পার্কে মুসলিম লীগের কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এই কনফারেন্সে বাংলার বাঘ আবুল কাশেম ফজলুল হক ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি তাঁর প্রস্তাবে বলেন, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বাস্তবতায় হিন্দু মুসলিম একসঙ্গে বসবাস অসম্ভব। সমাধান হচ্ছে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র এবং পূর্বাঞ্চলে বাংলা ও আসাম নিয়ে আরেকটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। জিন্নাহ লাহোর প্রস্তাবের ‘খতনা’ করার ফলে বাঙালিদের জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে।
১৯৫৪ সালের ৭-১২ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মোট আসন ছিল ৩০৯টি। তার মধ্যে ৭২টি হিন্দু ও তফসিলি। ২৩৭টি মুসলমান আসন। ৯টি বাদে সব আসনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ আসন থেকে মুসলিম লীগ প্রার্থী ওহিদুজ্জামান ঠাণ্ডা মিয়াকে পরাজিত করে প্রাদেশিক আইনসভার এমএলএ নির্বাচিত হন। শের-এ-বাংলা যুক্তফ্রন্টের নেতা নির্বাচিত হন। মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে যুক্তফ্রন্টে মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল তিনি চার সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১৯৫৪ সালের ১৫ মে পূর্ণাঙ্গ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভায় কৃষি, ঋণ, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী হন শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৫৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আইন পরিষদে অনাস্থার যুক্তফ্রন্ট সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে ভোট গ্রহণ করা হয়। এ কে ফজলুল হক ১৯৯ জন এবং আতাউর রহমান খান ১০৫ জন সদস্যের সমর্থন পান। অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল হল। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গেল। বোঝা গেল, শের-এ- বাংলার জনপ্রিয়তা কতটা উঁচুতে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা, একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘শহিদ দিবস’ ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা, ভাষা শহিদদের স্মৃতিতে ‘শহিদ মিনার’ নির্মাণ, পহেলা বৈশাখকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা, বর্ধমান হাউসকে বাংলা অ্যাকাডেমি করা, জমিাদারি ব্যবস্থার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করাসহ উপমহাদেশের মানুষের কল্যাণে নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত রেখেছিলেন তিনি। অসমাপ্ত আত্মজীবনী তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, বাংলার মাটিও তাঁকে ভালোবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি। একদিন আমার মনে আছে একটা সভা করছিলাম আমার নিজের ইউনিয়নে, হক সাহেব কেন লীগ ত্যাগ করলেন, কেন পাকিস্তান চান না এখন? কেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে মিলে
মন্ত্রীসভা গঠন করেছেন? এই সমস্ত আলোচনা করছিলাম। হঠাৎ একজন বৃদ্ধ লোক যিনি আমার দাদার খুব ভক্ত, আমাদের বাড়িতে সকল সময়েই আসতেন, আমাদের বংশের সকলকে খুব শ্রদ্ধা করতেন, দাঁড়িয়ে বললেন, ‘যাহা কিছু বলার বলেন, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাই না। জিন্নাহ কে? তার নামও তো শুনি নাই। আমাদের গরিবের বন্ধু হক সাহেব।’ এ কথার পর আমি অন্যভাবে বক্তৃতা দিতে শুরু করলাম। বঙ্গবন্ধুর বাবা বলেছেন, ‘বাবা তুমি যাই করো শের-এ-বাংলার বিরুদ্ধে কিছু বলো না। ও এমনি এমনি শের-এ-
বাংলা হয়নি।’

ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি বাঙালি। সেই সঙ্গে তিনি মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি মুসলমান। খাঁটি বাঙালিত্বের সাথে খাঁটি মুসলমানত্বের এমন অপূর্ব সমন্বয় আমি আর দেখি নাই। ফজলুল হক আমার ছাত্র বলে বলছি না, সত্য বলেই বলছি। খাঁটি বাঙালিত্ব ও খাঁটি মুসলমানত্বের সমন্বয়ই ভবিষ্যৎ বাঙালির জাতীয়তা’ (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, পৃষ্ঠা ১৩৫-৩৬)। হক সাহেব জানতেন, মাঝখানে ভারতকে রেখে পশ্চিম আর পূর্বে জোড়া দিয়ে এক পাকিস্তান করলে তা কখনো টিকবে না। জিন্নাহ আমার লাহোর প্রস্তাবের খতনা করে ফেলেছে বলে ফজলুল হক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয় থাকেননি। ফজলুল হক বলেছিলেন, একটি পাকিস্তান কখনও টিকবে না। ১৯৭১ সালে এসে দেখা গেল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হল। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ হল ফজলুল হকের লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন। একমাত্র রাষ্ট্রপতি হওয়া ছাড়া সম্ভাব্য সবধরনের পদে তিনি
অধিষ্ঠিত ছিলেন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে। তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী, পূর্ব বাংলার তৃতীয় মুখ্যমন্ত্রী; পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। অসীম সাহসী এই মানুষটি আমাদের সকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে প্রতিবাদ করার কথা বলেছেন। বাঙালি জাতিকে সতর্ক করে
দিয়েছিলেন অনেক আগেই। তিনি বলেছেন, ‘যে জাতি তার বাচ্চাদের বিড়ালের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ায়, তারা সিংহের সাথে লড়াই করা কীভাবে শিখবে?’


Spread the love

1 Comment

  1. Madhumita Gupta

    ওপর বাংলার বঙ্গবন্ধু ছাড়া আমরা কলকাতাবাসীরা বলতে গেলে কারুর সম্বন্ধে বেশি জানতে পারিনা ।সেই হিসেবে এই লেখাটি । খুব বেশি কারুর একটা জানতে পারিনা ।সেক্ষেত্রে সালমাজির এই লেখা অনেক নতুন খবর জানায় ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *