কাঞ্চনের খোঁজে লুংসেল

কাঞ্চনের খোঁজে লুংসেল
Spread the love

লেখা ও ছবি- চিন্ময় নাথ

আস্তানা থেকে মেরে কেটে কুড়ি মিনিটের ট্রেক। চড়াই ভেঙে পৌঁছতে হবে একটা উঁচু মতো জায়গায়। সেখানে পৌঁছোতে পারলেই কেল্লাফতে। পেয়ে যাব তাঁর দেখা। ভোর রাতে উঠে তৈরি হয়ে নিয়েছিলাম। পিঠে ক্যামেরার ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম ওইটুকু পথ একাই উঠে যাব। এই অজ গাঁয়ে আর পথ হারানোর কী আছে? কিন্তু না, মানুষ ভাবে এক হয় আরেক। এই যেমন এখন আমি সকালের আলো ফুটে গেলেও পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছি। কিছুতেই পৌঁছতে পারছি না ওই উঁচু মতন জায়গাটার ধারে কাছে। শুধু গ্রামের পথের পাকদণ্ডী বেয়ে ঘুরপাক খাচ্ছি। চড়াই ভাঙার পরিশ্রম আর টেনশনে এই জানুয়ারির প্রবল ঠান্ডাতেও ঘামছি। কেন? আরে মশাই,ওনার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। দেখা দেবেন বলে এসে গিয়েছেন। আর আমি কিনা পথ হারানো নাবিকের মতো খাবি খাচ্ছি। নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল। কথা না শোনার রাগ। কারণ, সঞ্জীবজি গতকাল রাতে পইপই করে বলেছিলেন, একা না যেতে। ওনাকে সঙ্গে নিতে। কিন্তু ওই যে, ওভার কনফিডেন্স। ওটাই ডোবাল। আর এই চান্স মিস করা মানে সারা দিন গালে হাত দিয়ে বসে থাকা। আর উনি দেখা দেবেন না। ফিরে যাবেন নিজের ডেরায়। কলেজ জীবনে প্রেমের কথা মনে করুন তাহলেই আমার করুণ পরিস্থিতিটা অনুভব করতে পারবেন। মনে ঝড় তোলা মেয়েটি অনেক বায়নাক্কার পর সময় তো দিয়েছে, কিন্তু আপনি সময় মতো পৌঁছতে পারছেন না। এ দিকে সে নির্দিষ্ট বাসস্টপে এসে দাঁড়িয়ে আছে। এবার বলুন, এই সিন হলে প্রেম টিকবে? আমার অবস্থাও সে রকম। প্রেমিকা এসে দাঁড়িয়ে আছে অথচ আমি পথ গুলিয়ে ফেলেছি। পৌঁছতে পারছি না তার কাছে।

এই সাত সকালে গোটা পাহাড়ি গ্রামটা ঘুমিয়ে আছে। প্রবল ঠান্ডায় কে আর আমার মতো ভবঘুরে হবে? চারদিক সুনসান। কাউকে যে জিজ্ঞেস করব শিব মন্দিরটা কোন দিকে? তারও উপায় নেই। আমার কাছে ল্যান্ড মার্ক বলতে ওই শিব মন্দির। ওখানে পৌঁছতে পারলেই পুরো তিনশ ষাট ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ভিউ খুলে যাবে চোখের সামনে। ঘাড় উঁচু করে তাকাচ্ছি পূব আকাশের দিকে। হাঁসের ডিমের কুসুম ভাঙা আলো ফুটেছে। গ্রামটাকে পিছনে ফেলে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি। প্রবল বিরক্তি নিয়ে মনে মনে বলছি কেন শুনিনি সঞ্জীবজির কথা। এ দিকে তাড়াহুড়োতে জলের বোতলটাও সঙ্গে আনিনি। চড়াই ভাঙতে ভাঙতে গলা শুকিয়ে কাঠ। পাথুরে রাস্তা দিয়ে একটা বাঁক ঘুরতেই দেখতে পেলাম একটি মেয়েকে। দেখে মনে হল খেলাধলা করে। বুকের কাছে ফুটবলটা ধরা। সদ্য কৈশোরে পড়া মেয়েটিকেই অন্ধের লাঠির মতো আঁকড়ে ধরলাম।

“তুমি বৃষ্টি চেয়েছ বলে কত মেঘের ভেঙেছি মন।”-শিয়ালদা থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রসে চেপে নিউ মাল জংশনে নামার পর এই লাইনটাই গতকাল মনে এসেছিল। কলকাতা থেকে বৃষ্টি মাথায় করে বেরিয়েছিলাম। জানুয়ারি মাস হলেও ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। নিম্নচাপের জেরে অকালবৃষ্টি। আবহাওয়ার মর্জির ওপর কারুর জোর খাটে না। তাই নিউ মাল জংশনে নেমে বেজার মুখে রিয়াজের গাড়িতে চেপে বসেছিলাম। জানলার কাচ তোলা। উইন্ডস্ক্রিনের ওপর বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে। ওয়াইপার একবার এপাশ আরেকবার ওপাশ করে জল সরাচ্ছে। মালবাজার ছাড়িয়ে ওদলাবাড়ি, মানাবাড়ি, তুরিবাড়ি, পাথরঝোরা চা-বাগান ছাড়িয়ে পঁয়তাল্লিশ কিমি পথ পেরিয়ে পৌঁছেছিলাম লুংসেলে। কালিম্পং জেলার ছোট্ট একটি পাহাড়ি গ্রাম লুংসেল। কোলাহল নেই। নেই পর্যটকদের ভিড়। পাহাড়ের কোলে ছিমছাম একটি হোমস্টে সঞ্জীবনী হোমস্টে। এই লুংসেলেই ক’টা দিন নিরিবিলিতে কাটাব বলে চলে এসেছি। হোমস্টে মালিক এই গ্রামেরই বাসিন্দা সঞ্জীব ছেত্রী। চমৎকার বাংলা বলেন। বৃষ্টি মাথায় করে এলেও বিকেলের দিকে আকাশ একটু পরিষ্কার হল। হলুদ আভা মাখানো রোদও ডানা মেলল সবুজ পাহড়ের বুকে। দুধের সরের মত মেঘ তখনও বাউন্ডুলে ছেলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে সবুজ উপত্যকায়। এক কথায় ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’। প্রথম দেখাতেই লুংসেলের প্রেমে পড়ে গেলাম।

ছোট্ট একটা ছবির মতো সুন্দর গ্রাম। অল্প কয়েকটা বাড়িঘর ইতিউতি ছড়িয়ে। গোটা গ্রামটা জুড়ে ধাপ চাষের সবুজ আভা ছড়ানো। একেই শীতকাল। রোদ পড়তেই হু হু করে তাপমাত্রা নামতে শুরু করেছিল। সন্ধ্যা নেমে গেছিল ঝুপ করে। সন্ধ্যার স্ন্যাকস বলতে গরম চা আর ভেজ পকোড়া। পকোড়া আর গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে সঞ্জীসজির সাথে গল্প করছিলাম। উনি বলছিলেন,“কাল সকালে আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে। দেখতে পাবেন কাঞ্চনকঙ্ঘা।” বিকেলের পর আর বৃষ্টি হয়নি। মনে মনে একটা আশা দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। জিজ্ঞেস করলাম,“দেখা পাব বলছেন?” উনি আশ্বস্ত করে বলেছিলেন,“মনে হচ্ছে পাবেন। আজ দিনভর বৃষ্টি হয়েছে তো, ফলে কাল ভোরে আকাশ পরিষ্কার থাকার চান্স বেশি।” জানতে চেয়েছিলাম, “কোনখান থেকে ক্লিয়ার ভিউ পাওয়া যাবে?” সঞ্জীবজি চায়ের কাপ সঙ্গে করে আমাকে নিয়ে ডাইনিং থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। বাইরের চাতালে দাঁড়াতেই একরাশ হিমেল হাওয়া ঝাপটা মারল চোখে মুখে। আকাশের দিকে আঙ্গুল তুলে উনি বললেন,“ওই দেখুন, আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে।” ঘাড় উঁচু করে তাকালাম। মনে হল কালো ওড়নার গায়ে কেউ যেন লক্ষ লক্ষ জোনাকি ছেড়ে দিয়েছে। সঞ্জীবজি বলে উঠলেন, হোমস্টে থেকে বেরিয়ে যে কাঁচা রাস্তাটা ওপরের দিকে উঠে গিয়েছে, ওটা ধরে এক-দেড় কিমি চড়াই ভেঙে ওপরে উঠতে হবে। গ্রাম ছাড়িয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কিছুটা গেলেই একটা সমতল মতন জায়গা পড়বে। ওখানে একটা ছোট্ট শিব মন্দির আছে। ওখানে গিয়ে দাঁড়ালে পুরো তিনশ ষাট ডিগ্রি ভিউ পাবেন। আর কপাল ভালো থাকলে পেয়ে যাবেন কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন।” আমি চায়ে চুমুক দিলাম। দেখলাম নিমেষের মধ্যে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে গরম চা। বললাম,“ঠিক আছে। আমি কাল ভোরে উঠে চলে যাব ওখানে।” “উঁহু,একা যাবার দরকার নেই। মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রাখুন। আমি তো একতলায় শোব। আপনি উঠে আমাকে একটা ফোন করে দেবেন। আমি তৈরি হয়ে নেব। আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। একা যেতে গেলে অন্ধকারে পথ হারাবেন।” আত্মবিশ্বাস ভালো কিন্তু অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস মানুষকে ডোবায়। আমাকেও ডুবিয়েছে। সঞ্জীবজির কথা না শুনে একাই ক্যামেরার ব্যাকপ্যাক নিয়ে আজ ভোর রাতে বেরিয়ে পড়েছিলাম। আসলে এই ঠান্ডায় অত ভোরে ওনাকে আর ঘুম ভাঙিয়ে বিরক্ত করতে চাইনি। কিন্তু সিদ্ধান্তটা বুমেরাং হয়ে যাবে ভাবিনি। যথারীতি অন্ধকারে পথ হারিয়ে গ্রামের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছি। দিনের আলো ফুটে গেলেও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁতে পারিনি। যখন আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম, তখনই দেখা হল সমীরার সাথে। ওই যে আগেই বলেছিলাম অন্ধের লাঠির মতো আঁকড়ে ধরেছিলাম পাহাড়ি কিশোরীকে। ওর নামই সমীরা। ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। ফুটবল খেলতে ভালোবাসে। তাই প্র্যাকটিস করতে যাচ্ছিল। এটা ওদের শর্টকাট। ও নিচে নামছিল। আর আমি ওপরে উঠছিলাম। নিচে একটা চার্চ আছে।

চার্চের কাছেই একটা মাঠ দেখেছিলাম একটু আগে। ও বোধহয় ওই মাঠের দিকেই যাচ্ছিল। সমীরা আমার ‘রক্ষাকর্তা’ হয়ে উঠল। নাকি ‘রক্ষাকর্ত্রী’ বলব? জানি না। সমীরাকে সমস্যাটা জানাতে ওই আমাকে নিয়ে চলল শিব মন্দিরের দিকে। বোল্ডারের রাস্তা ছেড়ে সমীরা গ্রামের ভেতর দিয়ে শর্টকাট নিল। আমিও চললাম ওর পিছু পিছু। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম অভীষ্ট লক্ষ্যে। একটা সমতল জায়গা। চারদিকটা খোলা। একটা গোলাপি রঙের শিব মন্দির। খুব ছোট। ভেতরে অধিষ্ঠান করছেন ভোলেবাবা।

মন্দিরটার ঠিক পিছনে গোটা উত্তর আকাশ জুড়ে ফুটে রয়েছে ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা। আমার পৌঁছতে দেরি হয়ে যাওয়ায় ততক্ষণে লালচে আভাটা কেটে গিয়েছে। শিবজিকে একটা প্রণাম ঠুকলাম। আর সমীরাকে কৃতজ্ঞতা জানালাম। ততক্ষণে পূব আকাশে কাঁচা হলুদ রোদ ডানা মেলেছে। ওপর থেকে পাখির চোখে দেখতে পাচ্ছি লুংসেল গ্রামটাকে। গোটা গ্রামটার গায়ে যেন কেউ কাঁচা হলুদ বেটে লাগিয়ে দিয়েছে।

ঘন্টাখানেক কাটালাম ওখানে। সমীরা সঙ্গ ছাড়েনি। আমাকে নিয়ে বেশ কিছুটা নিচে নেমে এল। আমাকে ফিরতে হবে হোমস্টেতে। সঞ্জীবজি হয়ত এতক্ষণে আমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছেন। মোবাইলটাও সঙ্গে আনিনি। গ্রামের ভেতর দিয়ে ফের শর্টকাট নিলাম। আমার গাইড সমীরা। সেই ভোররাত থেকে দৌড়ঝাঁপ করায় গলা শুকিয়ে কাঠ। সমীরাকে তেষ্টার কথা জানালাম। ও আমাকে ইশারায় একটু দাঁড়াতে বলল। তারপর উধাও হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এল জল নিয়ে। এইটুকু সময়ের মধ্যে ও কাচের গ্লাসে জল কোথা থেকে পেল? আমার মনের কথা বুঝতে পেরে ও বলে উঠল,“পি লিজিয়ে,সাফ পানি হ্যায়।” বুঝলাম গ্রামের কোনো বাড়ি থেকে আমার জন্য পানীয় জল জোগাড় করে নিয়ে এসেছে। ‘সাফ’ না ‘অসাফ’ বুঝি না. আগে তো তৃষ্ণা মেটাই। কিছুটা নেমে আসার পর দেখতে পেলাম চার্চটাকে। পাশেই খেলার মাঠ। জনাকয়েক পাহাড়ি ছেলে মিলে বল পেটাচ্ছে। সমীরা আমাকে বিদায় জানিয়ে মিশে গেল ওদের সঙ্গে। আর আমি বোল্ডার বিছানো উতরাইয়ে নামতে থাকলাম। উত্তর আকাশের কাঞ্চনজঙ্ঘা তখন রুপোর জলে আঁকা ছবির মত স্থির। আস্তে আস্তে তা চোখের আড়ালে চলে গেল।

হোমস্টের কাছাকাছি আসতেই খিদেটা চাগাড় দিয়ে উঠল। সেই ভোররাত থেকে ছুটছি। কিছুই খাওয়া হয়নি। নিদেনপক্ষে চা বিস্কুট দরকার। দূর থেকে দেখতে পেলাম সঞ্জীবজি হন্তদন্ত হয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। বুঝলাম আমার কপালে মৃদু বকুনি লেখা আছে।

পথের হদিসঃ

শিয়ালদা থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস ধরে নিউমাল জংশন। নিউমালে নেমে একটা গাড়ি ভাড়া করে চলে যেতে হবে লুংসেল। সময় লাগবে ঘন্টা দুয়েক। গাড়ি ভাড়া পড়বে ২২০০-২৫০০ টাকা। লুংসেলে থাকার জায়গা সঞ্জীবনী হোমস্টে। প্রতিদিন থাকা-খাওয়ার খরচ জনপ্রতি ১৩০০ টাকা। যোগাযোগ করতে পারেন সঞ্জীব ছেত্রীর সঙ্গে। ফোন নম্বরঃ 9126194489.


Spread the love

2 Comments

  1. Sayantani Sengupta

    পড়লাম দাদা। বেশ ভালো লেখা। আরো লিখুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *