রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প এবং অচর্চিত ‘লিপিকা’ (শেষ পর্ব)

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প এবং অচর্চিত ‘লিপিকা’ (শেষ পর্ব)
Spread the love

লিখেছেন কৃষ্ণ শর্বরী দাশগুপ্ত

কবিতায়, গানে, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, প্রবন্ধে বর্ণিল রবীন্দ্ররচনার নন্দনবনে বিস্ময়-পুষ্পটি হল ‘লিপিকা’। প্রমথ চৌধুরিকে লেখা এক চিঠিতে তিনি নিজে বলেছিলেন, “এই লেখাগুলিকে ‘কথাণু’ না-বলে ‘কথিকা’ বলা যেতে পারে। ‘গল্পস্বল্প’ বললেই বা ক্ষতি কি?” ৩ তখনও ‘অণুগল্প’ শব্দবন্ধটি চালু হয়নি। ‘লিপিকা’র মোট লেখার সংখ্যা ৩৯। এরমধ্যে ‘কথিকা’ লেখাটি লিপিকার প্রথম সংস্করণে ছিলনা। ১৩৫২ তে প্রকাশিত সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত হয়। ‘প্রবাসী’, ‘সবুজপত্র’, ‘ভারতী’, ‘মানসী ও মর্মবাণী’, ‘আগমনী’, ‘শান্তিনিকেতন’ –এমন বহু পত্রিকায় সেগুলি প্রকাশিত হয়েছে ১৩২৪ থেকে ১৩২৯-এর মধ্যে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষে বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলীতে ‘গল্প ও উপন্যাস’ পর্যায়েই ‘লিপিকা’র অন্তর্ভুক্তি। কিন্তু ‘লিপিকা’র লেখাগুলি আসলে গল্পই তো?– সচেতন পাঠক এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ভারি এক দ্বিধায় পড়েন। ‘পুনশ্চ’ কাব্যের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘লিপিকা’তেই প্রথম তিনি গদ্যকবিতা লেখার চেষ্টা করেন। তাঁর কথায়,”ছাপাবার সময় বাক্যগুলিকে পদ্যের মতো খণ্ডিত করা হয়নি– বোধকরি ভীরুতাই তার কারণ।” বিশ্বভারতী প্রকাশিত রচনাবলীর ২৬তম খন্ডে পরিশিষ্টের ‘গ্রন্থপরিচয়’ অংশে লিপিকার একটি লেখাকে ভারতী পত্রিকায় কিভাবে আবৃত্তির ছন্দ অনুযায়ী সাজানো হয়েছিল, তা তুলে দেওয়া হয়েছে। কবির এই ‘ভীরুতা’ শব্দের ব্যবহারে যে আবার হোঁচট লাগে! নিজের লেখাকে নিজের পছন্দমতো সাজাতে কবি ভয় পাচ্ছিলেন কাকে? পাঠক বা সমালোচকদের কি? তাঁর লেখাপত্র নিয়ে ইতিমধ্যেই যত সমালোচনা হয়েছিল, তার মধ্যে একটি ছিল, রবীন্দ্রসাহিত্যের সার্বিক গীতিধর্মিতা।

রবীন্দ্রনাথের কবিসত্ত্বা প্রভাবিত করেছে তাঁর সাহিত্যের বাকি সব ধারাকে, অনবধানে ছায়া ফেলেছে তাঁর গল্পকাহিনীর ওপরেও, এ-ই ছিল তাঁদের বক্তব্য। রবীন্দ্রনাথ একথা মানতে একেবারেই রাজি ছিলেননা। নিজের লেখা গল্পগুলি নিয়ে তাঁর একটা শ্লাঘার জায়গা ছিল। তাঁর মতে, কবিতা বা গান রচনার সময়ে কল্পনার পরিসরটুকু সঙ্গত কারণেই রাখতে হয়েছে, কিন্তু গল্পে তার কোন অবকাশই নেই। সেখানে যা তিনি নিজের চোখে দেখেছেন ( তারমধ্যে অনেকটাই জমিদারি দেখাশোনার কাজে পদ্মায় বটে থাকাকালীন ) গল্পে সেটুকুই লিখেছেন, সংযোজন করেছেন শুধু ফাঁকগুলি ভরাট করতে। কবির প্রতিক্রিয়া থেকে মনে হয়, ‘গীতিধর্মিতা’কে তিনি বিরূপ সমালোচনা বলেই ধরেছেন। ৪ কাব্যিক কাল্পনিকতার ভেজাল নিয়ে গদ্য রচনার অতিরঞ্জন যে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না সেটাই সর্বতোভাবে বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু গদ্যরচনায় কাব্যসুষমা লেগে গেলেই সেটা অপরাধ বলে গণ্য হবে, নাকি গদ্যকেই তা দেবে এক অন্যতর মাত্রা — এসব সমালোচকদের কূট তর্ক, যার মীমাংসা হওয়া দুষ্কর। তবে মোদ্দা
কথা হল, তাঁর গদ্যে, বিশেষত গল্পে, এই গীতিধর্মিতা ব্যাপারটি নিয়ে অস্বস্তি ছিল বলেই হয়ত ‘কথিকা’- দের কবিতার অবয়ব দিতে তাঁর আপত্তি। ‘লিপিকা’র এই অতিক্ষুদ্র ‘কথাণু’-গুলির দু’একটিকে একটু নেড়েচেড়ে তার গঠনশৈলীর একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। ধরা যাক ‘প্রশ্ন’। প্রথম ক’টি সহজ সরল বাক্য পাঠককে যেন আচমকা ধাক্কা দেয়। ‘শ্মশান হতে বাপ ফিরে এল। তখন সাত বছরের ছেলেটি– গা খোলা, গলায় সোনার তাবিজ একলা গলির উপরকার জানলার ধারে। কী ভাবছে তা সে আপনি জানেনা।’ এ তো আস্ত একটি গল্পই। রবীন্দ্রনাথ সেই যে সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, ‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে/ সাঙ্গ করি মনে হবে
/ শেষ হয়ে হইল না শেষ’। একেবারে সংক্ষিপ্ত এ গল্পে বিস্তারের কোন বাহুল্য নেই, মায়ের মৃত্যুর কার্যকারণ আমরা জানতে পারিনা। কে এই শিশু, সে কি মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পরে শমী, নাকি শিশু রবীন্দ্রনাথই স্বয়ং–এ প্রশ্নও অবান্তর, জেগে থাকে শুধু কাহিনীর হৃদয় নিংড়ানো সারাৎসার –বিপুল শোকের ছবিটি, ছোট শিশু যার ভয়াবহতা জানে না। পাঠককে তা কিছুক্ষণের জন্যে চুপ করিয়ে দেয়। রাতের অন্ধকারে তিনিও যেন এসে দাঁড়ান ছাদে শিশুটির পাশে, আকাশের দিকে তাকিয়ে খোঁজেন স্বর্গে যাবার
রাস্তা। ‘প্রশ্ন’ গল্প তো বটেই, বরং তারও বেশি কিছু। কিন্তু এই ‘কিছু’র অন্যমাত্রাটিকে আমাদের গড়পড়তা বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারছি না বলেই তাকে কবিতার ছাপ মেরে দেওয়াটাও কাজের হবে কি? তেমনি ‘ভুল স্বর্গ’, ‘সুয়োরানীর সাধ’, ‘তোতাকাহিনী’ বা ‘কর্তার ভূত’ — গল্প সবেতেই আছে। সূচনা, উপসংহার, কোথাও কোনো খামতি নেই। মাটির পৃথিবী থেকে ভুল করে যে অকেজো লোকটিকে স্বর্গে নিয়ে যাওয়া হল সে যে কোন মানে ছাড়াই, শুধু মনের খুশিতে কাজ করে, সুখের গজদন্ত মিনারে বসেও দুয়োরানীর দুঃখটুকুর জন্যে সুয়োরানি যখন কাঙালপনা করে, এই অন্যরকমের ব্যাপারগুলো আমাদের প্রতিদিনের মোটা দাগের চেনা গল্পের সঙ্গে মেলেনা। আর তখনই তাকে আমরা ‘কাব্য’ বলে একঘরে করে দিতে চেষ্টা করি। এ
বইয়ের সব লেখা আবার গল্পের প্রচলিত অবয়বের সঙ্গেও খাপ খায়না। ‘গলি’ যেমন। না আছে তার নায়ক, না কোন কাহিনীর সংঘাত। একলা এক শহুরে গলি নিজেই যে চরিত্র হয়ে উঠতে পারে, কস্মিনকালেও এমনটা কি কেউ ভেবেছিল? এই বিচিত্ররসের আবেদন পুরোপুরি পাঠকের বোধের কাছে, তার দৃষ্টি, পঠন বা ভালোলাগা মন্দলাগার তোয়াক্কা তার নেই। এই অন্যরকমের লেখাগুলি কবি কখন লিখলেন, কেন লিখলেন, সেটা জানলে এর চরিত্র অনুধাবন করতে সুবিধে হয়। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড রবীন্দ্রনাথের সমস্ত সত্ত্বাটিকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দেয়। সেসময়ে কিছুদিন তীরবিদ্ধ পাখির মতো ছটফট করেছেন কবি। শেষে একদিন সারারাত জেগে ব্রিটিশ সরকারকে চিঠি লেখেন নাইট উপাধি প্রত্যাখ্যান করে। সকালে সেই চিঠি ডাকে দিয়ে আসেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ।

এরপরই বুঝি যন্ত্রণার উপশম। প্রশান্তচন্দ্র যখন বিকেলে আসেন কবি তখন তেতলার ঘরে। লিখছেন এক নতুন লেখা — সেই ছোট ছেলেটির মাতৃশোকের আখ্যান, আখ্যান নাকি কবিতা! প্রচন্ড আঘাতে ক্ষতবিক্ষত কবিহৃদয়ের রক্তক্ষরণ। ‘লিপিকা’র একেবারে শেষের ‘সংযোজন’ থেকে কয়েকটি লাইন বিচ্ছিন্ন ভাবে মনে করা যেতে পারে — ‘এবার মনে হল, মানুষ অন্যায়ের আগুনে আপনার সমস্ত ভাবীকালটাকে পুড়িয়ে কালো করে দিয়েছে, সেখানে বসন্ত কোনদিন এসে আর নতুন পাতা
ধরাতে পারবে না।…পথের ধারের দিকে চাইলুম। চমকে উঠে দেখি, ধুলোর মধ্যে একটি কাঁটাগাছ; তাতে
একটিমাত্র ফুল ফুটেছে…আমার বীণা বললে, “সুর লাগাও।” ‘লিপিকা’র পুরো বইটির লিপিকা’র পুরো বইটির সিংহভাগ লেখা হয়েছিল নাইটহুড ত্যাগ করে সেই অগ্নিবর্ষী চিঠিটি ডাকে দেবার পর। রচনার কালানুক্রমিক সূচি থেকে জানা যাচ্ছে’ এরমধ্যে ‘সবুজপত্রে’ প্রকাশিত ‘তোতাকাহিনী’ (মাঘ,১৩২৪), ‘স্বর্গ মর্ত্য’ (ফাল্গুন,১৩২৫) এবং ‘ঘোড়া’ (বৈশাখ,১৩২৬) — এই তিনটি
লেখা ছাপা হয়েছে তাঁর এই অশান্ত সময়ের আগেই। লিপিকার প্রকাশকালে রবীন্দ্রনাথ নিজেই হয়ত এগুলিকে বইটির অন্তর্ভুক্ত করেন। এছাড়া বাকি লেখাগুলি লেখা হয়েছিল একটা ঘোরের মধ্যে। সে ঘোরযখন কেটেছে, দুঃসহ জ্বালা বুঝি স্তিমিত হয়েছে ততদিনে। তিনি নিজে বিস্মিত হয়েছেন এ লেখার আশ্চর্যভাষা, একেবারে নতুন চেহারা দেখে। ১৩৩৯ (ইং ১৯৩২) বঙ্গাব্দে ‘পুনশ্চ’ প্রকাশের সময়ে কবি নিজে বলেছেন, ‘লিপিকা’ ছিল তাঁর গদ্যকবিতা রচনার প্রথম চেষ্টা। আসলে ‘গীতাঞ্জলি’র গান ইংরেজি গদ্যে
অনুবাদ করার পর কাব্য হিসেবে যখন তা স্বীকৃতি পেল, কবি তখন থেকেই চেয়েছেন পদ্যের ছন্দ থেকে মুক্ত করে বাংলা গদ্যে কবিতার রস দেওয়া যায় কিনা পরীক্ষা করে দেখতে। ‘লিপিকা’ যদি তার নান্দীপাঠ হয়ে থাকে তবে সেটি পরিণতি লাভ করে ‘পুনশ্চ’তে, ‘ক্যামেলিয়া’ বা ‘সাধারণ মেয়ে’র মতো গদ্য কবিতার একেবারে আধুনিক চেহারায়। এগুলির মধ্যেও গল্প আছে তবে তা কবিতার আধারে। ‘লিপিকা’র গল্পগুলির আধারকে কিন্তু ঠিক ততটা সহজে কবিতা বলে আখ্যায়িত করা যাবে না। প্রতিনিয়ত যিনি সাহিত্যের সবক’টি বিভাগে কাঁটাছেঁড়া চালিয়ে গেছেন তাঁর রচনার চরিত্র নির্দিষ্ট করা কঠিন। ‘ভুল স্বর্গ’ যদি জায়গা বদলে ‘লিপিকা’ থেকে ‘গল্পগুচ্ছে’ চলে আসে, আর কল্পনা-জারিত ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ স্থানান্তরিত হয় ‘লিপিকা’য় খুব কি বেমানান হবে? রবীন্দ্রনাথ যে বাংলা ছোটগল্পকে বঙ্কিমী কাঠিন্য থেকে বাঁচিয়ে হাত ধরে চলতে শিখিয়েছিলেন, তাঁরই তৈরি করে দেওয়া রাস্তায় হেঁটে আজ সে যথেষ্ট স্বাবলম্বী, যশস্বী সাহিত্যিকদের দৌলতে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হয়েছে তার ভান্ডার। বিশ্বকবির এক দুঃসহ রাজনৈতিক যন্ত্রণার প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ‘লিপিকা’র আত্মপ্রকাশ। একমাত্র এই উচ্চতার মানুষের ক্ষেত্রেই বোধহয় হিংসার অভিঘাতেও এমন একটি নান্দনিক উদ্ভাস সম্ভব। তবে সেই উত্তেজনা নিরসনের পর রবীন্দ্রনাথও কিন্তু তাঁর নিজের এই সৃষ্টিকে নিয়ে আর বিশেষ কিছু ভাবেননি। যদিও সাহিত্যের অঙ্গনে এরপরেও তাঁর দীর্ঘ ১৯ বছরের সৃষ্টিশীল উপস্থিতি। সত্যি বলতে কি গল্প এবং না-গল্পের মাঝামাঝি অবস্থানে এই বিশিষ্ট লিখনশৈলীর সঠিক নামকরণও কবি করে যাননি, যার জন্যে এর আলাদা কোন পরিচিতি গড়ে ওঠেনি। ‘লিপিকা’র প্রকাশকাল আগস্ট, ১৯২২। তার শতবর্ষের চৌকাঠ পেরিয়ে একজন পাঠক
হিসেবে মন্তব্য করা বোধহয় ভুল হবেনা যে, রবীন্দ্রসাহিত্যের এই অচর্চিত শাখাটি একদিকে যেমন স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল ও অনন্য, অন্যদিকে তেমনি নিঃসঙ্গতাতেও একক। আজ পর্যন্ত ‘লিপিকা’র যোগ্য উত্তরসূরি হবার দৃষ্টতা আর কেউ দেখাননি, এমনকি অনুকরণেরও না।

তথ্যসূত্র
১। <ছিন্নপত্র: ইন্দিরা দেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রের সংকলন>
২। <আলাপচারী: রবীন্দ্রনাথ — রাণী চন্দ >
৩। <রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রের সংকলন>
৪। <রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প: একটি পর্যালোচনা — মোরশেদ শফিউল হাসান। কালি ও কলম, সেপ্টেম্বর
২৫, ২০১৭।>

প্রথম পর্বের লিঙ্ক- https://bangalinama.com/lipika-rabindranath/


Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *