দিদার ডায়েরি (পর্ব ৩)

দিদার ডায়েরি (পর্ব ৩)
Spread the love

৬২ বছর আগে একা কেদার-বদ্রি ঘুরে এসেছিলেন এক বাঙালি মহিলা সুবাসিনী গুহ। তাঁর সেই ভ্রমণ-ডায়েরি এবার বাঙালিনামায় ধারাবাহিক লেখায়। (বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে)

সুবাসিনী গুহ

৫ই মে শনিবার

খুব ভোরে গৌরী কুন্ডে স্নান করিলাম | গরমজলের কুন্ডে স্নান করিয়া শরীরের সব গ্লানি চলিয়া গেল । জয় কেদারনাথ। যাত্রা আরম্ভ । আজই কেদারনাথে পৌঁছাইব। 8 মাইল আসিয়া রামবরা চটি আসিলাম | ঘোড়া হইতে সব যাত্রী নামাইয়া ঘোড়া পার হইল। আমরা বরফের উপর দিয়া চড়াই পার হইলাম । সিঁড়ি কাটিয়া দিয়াছে বরফের ওপর। চারিদিকে বরফ । নদী জমিয়া আছে। এখন রৌদ্র আছে । কাছের দোকানে বসিয়া পড়ি। থলে হইতে বিস্কুট আর চা খাইলাম | এখন অপেক্ষা করিব নন্দরা কখন আসে | আরও নাকি বরফের চড়াই আছে। জয় কেদার নাথ। অপেক্ষা করিতে করিতে শরীর থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। বুক ধড়ফড় করিতেছে । দোকান হইতে গরম দুধ কিনিয়া ক’ফোঁটা ব্রান্ডি দিয়া খাইলাম। ঘোড়াওয়ালাকে চা আর পাঁপড় দিলাম। ওদের না দিয়া খাওয়া যায়না। বড়ো গরীব । এইখানে মাফলার হারাইলাম | নন্দ ও পচা আসিয়াছে । আবার চলিলাম। সামনে কেবল বরফ। মাঝে মাঝে বরফের উপর হাঁটিতে হইবে। ঘোড়া চলিবেনা। আবার একটা বরফের চড়াই উতরাইলাম | আরো আড়াই মাইল। আবার একটা দোকানে বসিয়া চা খাইলাম। বুকে একটু বল পাইলাম। জ্যৈষ্ঠ মাসে বরফ কম থাকে। গরুড় ভগবান চটি আসিল। ঘোড়া হইতে নামিলাম। ঘোড়া আর সামান্য যাইবে। চারিদিকে বরফ। বসিয়া পাহাড়ের শোভা দেখিতেছি। কি চমৎকার দৃশ্য। এতদিন দুর হইতে হিমালয় দেখিয়াছি। এখন হিমালয়ের উপর বসিয়া আছি। বেলা দুইটায় কেদারনাথ গেছিলাম। সন্ধ্যায় আরতি দেখিলাম ।

৬ই মে রবিবার

আজ কেদারনাথের পুজা দিয়া রওনা হইব। বরফে জমিয়া আছি। কাল যে ভাবে বরফের উপর দিয়া আসিয়া সব অস্থির হইয়া বেকিয়া চুরিয়া আগুনের কাছে পড়িয়া ছিলাম । মনে হইয়াছে আর বাঁচিবনা। এই শেষ। যাক , বাবার দয়ায় আজ ভালো আছি। বরফ আজ অনেকটা সহ্য হইয়াছে। কাল চা বিস্কুট ছাড়া পেটে কিছুই পড়ে নাই। সকাল ১০ টায় পুজা শেষ করিয়া বাড়ী আসিলাম। ফলহারী বাবাকে দেখিলাম | পান্তা ভাত, বড়ির ঝোল, শাক ভাজা, পাঁপড় আর আলুর তরকারী খাইতে দিল। আশীর্বাদ ও ব্রহ্মকমল দিল | কেদারনাথ হইতে ফেরার রাস্তা ১২ টায় রওনা হইলাম | গৌরীকুন্ড ৭ মাইল , ঘোড়া নিলাম। ঘোড়ায় নামার সময় বেশিরভাগ বরফ হাঁটিয়া পার হইলাম | গোরীকুন্ড আসিয়াছি। দোকানের ঘরে বিছানা করিয়া বসিলাম। নন্দরা আসিতে দেরি আছে । আজ এখানে রাত্রিবাস। পথে বৃষ্টি হইয়া নাকালের একশেষ।

৭ ই মে সোমবার

ভোরে কুন্ডে ন্নান করিয়া যাত্রা করিলাম । এবার আমি হাঁটিব | দেখি কত দুর হয় | পথে দুইটা কাঠের বাটি কিনিলাম | বিশ্রাম ও খাওয়া রামপুর চটিতে | পথে ঢেঁকির শাক তুলিয়া ছিলাম | ৪ মাইল হাঁটিয়া আসিলাম | আবার ভাত ডাল শাকভাজা খাইয়া আরও ৫ মাইল আসিলাম | ফাটা চটিতে চা খাইলাম | এখানেই রাত্রিবাস।

সুবাসিনী গুহ’র ডায়েরির পাতা থেকে

৮ই মে মঙ্গলবার

আজ সকালে ফাটা চটি ছাড়িলাম। কাল রাত্রে বেশ ঘুম হইয়াছে। চা খাইয়া রওনা হইতেছি। এখানে হারিকেন খোয়া গেল । ঘোড়া করিলামনা। হাঁটিয়াই চলিয়াছি। ৭ মাইল হাঁটিয়া গুপ্তকাশী পৌঁছিলাম | ধর্মশালায় আছি। এখন আবার ২ মাইল হাঁটিয়া কুণ্ড চটি যাইব। কুণ্ড চটি গেলে বাসের রাস্তা আরন্ত হইবে । জয় বদ্রি বিশাল কি জয় | আজ মোট ৯ মাইল হাঁটিলাম | ২ মাইল বিশ্রী রাস্তা। টিকিট পাইলে এখন রুদ্রপ্রয়াগ রওনা হইব । রওনা হইলাম| আগে বাসের মেঝেতে, পরে সিট পাইলাম সন্ধ্যার আগে রুদ্রপ্রয়াগ আসিলাম সেই পুরানো দোকান ঘরে। মনে হয় বাড়ী আসিয়াছি। এখানে কিছু মাল জমা আছে। অগস্ত্য চটির কাছে রাস্তা খারাপ ছিল। এখন মেরামত হইতেছে।

৯ই মে বুধবার

বদ্রিনাথের টিকিটের চেষ্টা হইতেছে কবে পাই কে জানে ? পোটলা আবার নতুন করিয়া রেডি করিলাম | জামাকাপড় সব ময়লা | সব কাচিলাম। বাসস্ট্যান্ডে গিয়া বসিয়া রইলাম। বাসের টিকিট পাওয়া গেলনা । বহুলোক বসিয়া আছে। এখানে অনেক দোকান। পোস্ট অফিস। এখানে মিলিটারি গাড়ী খুব চলিতেছে। একটি দোকানে রাত্রিবাসের জন্য রহিলাম। প্রায় ষোল জন| কেহই পা মেলিয়া শুইতে পারিবেনা। তবু এটি বাস স্ট্যান্ডের কাছে। সকাল সকাল বাসের জন্য চেষ্টা করিতে পারিব | এর আগে হিসেবের বাইরে আমরা বাসে জায়গা পাইয়াছি ড্রাইভার এর সাথে বন্দোবস্ত করিয়া। এবার হইলনা। কড়া পুলিশ পাহারা । জয় বদ্রিনাথ। দাঁত ব্যথা করিতেছে। একটা সারিডন খাইলাম | মাইক চলিতেছে। এই জায়গা খুব জমজমাট | এক পশলা খুব বৃষ্টি হইল। এক শিশি আমলা তেল কিনিব। দুদিন যাবত সরিষার তেল মাথায় দিতেছি।

১০ই মে বৃহস্পতিবার

ঘোর অন্ধকার থাকিতে থাকিতে বাসে বসিলাম । পাঁচটায় বাস ছাড়িল | ধান ঝাড়ার মত করিয়া বাস চলিয়াছে ৷ কর্ণপ্রয়াগে বাস থামিল। হঠাৎ বাসে বসার সুযোগ পাইয়া গোছগাছ না করিয়া চলিয়া আসিয়াছি। পথ চলার লাঠিটা দোকানে পড়িয়া রহিল। কর্ণপ্রয়াগ ছাড়িলাম | নামার সুবিধা হইলনা । এই রাস্তা কেদারের চেয়ে কিছু চওড়া । ভয় কম করে| কিন্তু ভীষণ ঝাঁকায়। আমরা গাড়িতে বসিয়া চা খাইতে গিয়া ,কি বিপদ ঝাঁকিতে সব পড়িয়া গেল। চামৌলি , এখানে 8৫ -৪৬ খানা টিনের ঘর আছে, মিলিটারি ক্যাম্প আছে । পি ডারিউ ডি অফিস আছে দেখিলাম | পথে পচা নামিয়া গেলো , এখানে চেক হইবে। কিছুক্ষণ বাদে পচাকে তুলিয়া লইল | বেআইনি বাসে উঠিয়াছি আমরা| পিপুলকোঠী আসিল | ৮ ঘন্টা ধরিয়া বাস আছড়াইতে আছড়াইতে আনিতেছে। প্রাণ গেল। ২টা বাজিবে যোশীমঠ নামিতে | পিপুলকোঠীর পর বাস চড়াই উঠিতে লাগিল। বেলা ৪টেতে যোশীমঠ পৌঁছাইলাম | বেশ শহর শহর ভাব । কাছেই পুলিশ স্টেশন | দোকান । নানা রকম মিষ্টি। একটা লাঠি কিনিব। নন্দর গামছা বাসে হারাইল।

১১ই মে শুক্রবার

পরদিন সকাল সাতটায় যোশীমঠ ছাড়িয়া হাঁটিয়া ৩ মাইল আসিলাম | পথে কান্ডি পাইয়া আরো তিন মাইল আসিলাম। খুব খারাপ রাস্তা | পথ চড়াই। বহুকষ্টে চটিতে আসিলাম। ভীষণ নিচে গঙ্গা। একজনের টাকা চুরি গেল। পচা স্নান করিতে গিয়া সোয়েটার হারাইল । দুখানা পুরী খাইয়া আরো ২ মাইল হাঁটিয়া পান্ডুকেশ্বর চটিতে আসিলাম। এখানে পান্ডুরাজা তপস্যা করিয়াছিলেন পরে পান্ডবরা মন্দির করিয়াছে।

১২ই মে শনিবার

আজ সকালে তিন মাইল হাঁটিয়া লামবগর চটিতে আসিলাম | একটা পান মুখে দিয়া রওনা হইলাম । বিনায়ক চটিতে বসিলাম। বেলা দশটায় বগর চটি । পথ ঢড়াই। পাথর জল পার হইলাম বহুকৃষ্টে। আবার বৃষ্টি – চোখে কানে দেখিনা । এখানে খাইয়া আবার রওনা | ডিনামাইট দিয়া পাথর ভাঙার শব্দ পাইতেছি। জয় বদ্রি বিশাল, বেলা সাড়ে তিনটায় হনুমান চটিতে পৌঁছিলাম | আরো ৫ মাইল বদ্রিনাথ।

১৩ই মে রবিবার

কাল রাত্রে চোর আসিয়াছিল। রাত্রে হৈ হৈ। কতগুলি লোক শুইয়া ছিল ওদের নাকি ১৫০ টাকা চুরি হইয়াছে। একটা লোকের কি কান্না | সাবধান হইলাম। আজ সকালে দেখা গেলো নন্দর টাকার থলি নাই। খুচরা ও নোট মিলিয়া একশত হইবে । সকলেরই মন খারাপ । কান্ডি ঠিক হইয়াছে বদ্রি পৌঁছাইয়া দেবে। ৪ টাকা, ৫ মাইল । সস্ত্রীক এক ভদ্রলোক নন্দর টাকা চুরি গিয়াছে শুনিয়া নিজের পকেট খুঁজিয়া দেখিল ২৭০ টাকা নাই। সব হায় হায়। এতদিন এ পথে কোনো চোর টোর দেখা যায় নাই। এ আবার কি কান্ড! যা ভয় হইতেছে। পুলিশ আসিয়া ইনকোয়ারী করিল। উহারা ছয়জন লোক ছিল। ৫ জন ছিল, ১ জন চলিয়া গিয়াছে। ৫ জনকে সার্চ করিয়া নন্দর কিছু রেজকি ও টাকা দেখা গেল। ৫ জনকে পুলিশ আটকাইয়া রাখিল৷ হ্যাঙ্গামা মিটাইয়া আমাদের রওনা হইতে হইতে সাড়ে নটা বাজিল | রাস্তায় গরম দুধ খাইলাম । খালি পেটে গা বমি করে। বেলা বারোটায় আসিয়া বদ্রিনাথের দুয়ারে পৌছাইলাম৷ ধুলাপায়ে মন্দিরে গেলাম । মন্দির বন্ধ হইয়া গিয়াছে । চারিদিকে বরফ কিন্তু তত ঠান্ডা নয় | হাওয়া বেশ গরম | বেশ জমজমাট | খাবার ও অন্যান্য দোকান বেশ আছে । ধীরেন পান্ডার বাড়ী আসিয়াছি। বেশ ভালো ঘরে স্থান পাইলাম | পুরু গালিচা পাতা । তালা বন্ধ করিয়া সব তপ্তকুন্ডে স্নান করিলাম। খুব গরম জল ঘটি করিয়া গায়ে দিতে হয় । দুইটা জায়গা দিয়া গরম জল পড়ে । মস্ত বড় কুণ্ড। ৪২ টা উচু সিঁড়ি ভাঙ্গিয়া নিচে নামিতে হয়| নিচে আছে নারদ কুণ্ড ঠান্ডা জল | আজ আর অন্ন জুটিবেনা। সূর্যাস্ত হইয়া গেছে। বাজার হইতে একটা মালপো – চার আনা , জিলীপি ২ খানা -চার আনা আর দু পয়সার আলু সিদ্ধ আনিয়া জল খাইলাম । জয় কেদার বদ্রি বিশাল।

(ডায়েরির বাকি অংশ পরের পর্বে )
দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্ক – https://bangalinama.com/kedar-bodri-diary-part-2/


Spread the love

1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *