দিদার ডায়েরি (পর্ব ২)

দিদার ডায়েরি (পর্ব ২)
Spread the love

৬২ বছর আগে একা কেদার-বদ্রি ঘুরে এসেছিলেন এক বাঙালি মহিলা সুবাসিনী গুহ। তাঁর সেই ভ্রমণ-ডায়েরি এবার বাঙালিনামায় ধারাবাহিক লেখায়। (বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে)

সুবাসিনী গুহ

কেদারনাথ যাত্রা  

গুপ্তকাশী হইতে কেদারনাথ আসা যাওয়া – ৫২ মাইল  

ঘোড়া –৩১ মাইল  

হাঁটা – ২১ মাইল  

বদ্রীনাথ যাত্রা 

যোশীমঠ হইেত বদ্রীনাথ আসা যাওয়া – ৩৮ মাইল , উৎরাইতে ২ মাইল বেশী অর্থাৎ ৪০ মাইল ।  

কান্ডি -৮ মাইল

হাঁটা – ৩২ মাইল

জিনিষ লইেত হইবে : 

এনামেলের বাটি , থালা ,ঘটি , পিতলের গ্লাস ,কলাই গ্লাস, চামচ , কেটলী , ছাকনি , হারিকেন , মশারী, কম্বল , চাদর , বালিশ , পরনের তাঁতের ধুতি , পুরান ধুতি , সেমিজ, তসর, উলের ব্লাউজ , ফুলহাতা , গরম চাদর , সুতার চাদর , ফ্লানেলের আন্ডারওয়্যার , মাফলার , গরম জলের ব্যাগ, ছুরি, কাঁচি, চিরুনি, ব্লেড , জলের বোতল, কনডেন্সড মিল্ক, টফি, সুচ , সুতা , দোয়াত , কলম , পেন্সিল , মধু, ব্যান্ডিস, তুলা, গার্ডার , ডেটল, বার্ণল, পাউডার , এন্তেরোকুইনাল, গ্লিসারিন , অমৃতার্জন , কোডপাইরিন, স্যারিডন, আ্যানাসিন; ব্রান্ডি (ঠান্ডা লাগিলে দশ ফোঁটা এক কাপ গরম দুধ বা জলের সাথে খাইতে হইবে)।

বুধবার ২৫শা এপ্রিল

হরিদ্বারের বিনায়ক ধর্মশালা হইতে হৃষিকেশ রওনা হইলাম | জওহরলাল আসিতেছে বলিয়া বাস আটকাইয়া রহিল রাস্তায়। ৯ খান গাড়ীতে জহরলাল গেল, তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। বাস বিগড়াইলো। আড়াই ঘণ্টা পরে অন্য বাস আসিল। মালপত্র টানিয়া নতুন বাসে চাপিলাম | এক ঘন্টা পরে হৃষিকেশ আসিলাম | ভগবান ধর্মশালায় ঘর পাইলাম না । আলমারিতে তালা দিয়ে মালপত্র রাখিয়া বারান্দায় শুইলাম। দোকান হইতে মুগের লাড্ডু খাইলাম । রাত্রে ঘুম বেশ হইলো । খুব হাওয়া ছিল।

২৬শা এপ্রিল বৃহস্পতিবার

ভোরবেলা উঠিয়া বাসস্ট্যান্ড আসিয়া দোকানে চা খাইতেছি ও লিখিতেছি । বাস ছাড়িবে ৮ টায়। লছমনঝুলা যাইবো । কাল হৃষিকেশ দেখিব | যদি বাসের টিকিট পাওয়া যায় তবে খুব সম্ভব শনি বা রবিবার কেদার বদ্রীর দিকে রওনা হইবো৷ ১৫ মিনিটেই লছমনঝুলা পৌছিলাম। পুল পার হইলাম | গীতাভবনে গঙ্গার ঘাট অতি সুন্দর | এখানে স্নান করিলাম |গঙ্গার জল ঘোলা। মাছ আছে তাই আটার গুলি দিলাম। নৌকা করিয়া এপারে আসিলাম। তারপর টাঙ্গা করিয়া হৃষিকেশে ধর্মশালায় উঠিলাম। ছবি ও এবি কে (আমার মাসী ও মা) চিঠি দিলাম |

২৭শা এপ্রিল শুক্রবার

গঙ্গায় স্নান করিয়া আসিয়া খাইয়া নিলাম। বাসের টিকিট পাওয়া গিয়াছে। বাঁদরে আমার একপাটি চটি নিয়া ছিড়িয়া ফেলিল। নন্দরটা হরিদ্বারে বামানন্দ আশ্রমে খোয়া গিয়াছে । যাক এবারতো কেডস সুই চলিবে । জয় কেদার বদ্রী- চটি এখানে পড়িয়া রহিল। সকাল দশটায় আসিয়া মালপত্র নিয়া বসিয়া আছি। শুনিলাম বেলা তিনটার আগে বাস পাইব না। বাস আসিল না| বিকাল সাড়ে চারটায় মালপত্র লইয়া গোপাল কুটির ধর্মশালায় ফিরিলাম | কাল সকাল সাড়ে সাতটায় আবার টিকিট পাওয়ার কথা । একটা ঘরে আশ্রয় পাইয়াছি। চমৎকার বাড়ী | ফ্যান, লাইট ,বাগান ইত্যাদি | ভগবান ধর্মশালায় বারান্দায় ছিলাম। কেদার বদ্রির কি ইচ্ছা একবার আস্তাকুড়ে আবার রাজপ্রাসাদে |এখন এইরকমই চলিবে – এই পথের এই নিয়ম। একদলের সাথে মায়াকুঞ্জ (সাধুদের বাস) দেখিয়া আসিলাম।

২৮শা এপ্রিল শনিবার

ভোর চারটায় বাসে বসিলাম দেবপ্রয়াগ যাইবার মানসে। ফাস্ট ক্লাসে আমরা পাঁচজন যাত্রী | বাসে বসিয়া চা খাইলাম | বাস ছাড়িল সকাল আটটায় | সাড়ে আটটা নাগাদ এক জায়গায় বাস থামাইয়া সব কলেরার ইনজেকশন দিয়া দিল । সঙ্গের সার্টিফিকেট মানে নাই । ডাক্তারের স্ট্যাম্প নাই – সরকারি ডাক্তার এবং তার স্ট্যাম্প চাই । ব্যথা করিতেছে। কি হয় কে জানে । বাস চলিতেছে। কি বিপদসংকুল রাস্তা। জয় কেদারজী নাম জপ করিতে করিতে চলিয়াছি। পৌনে বারোটায় বাস দেবপ্রয়াগে গৌঁছিল। মালপত্র লইয়া আমরা একটা ঘরে আশ্রয় পাইলাম | গঙ্গায় যেমন স্রোত তেমন ভীষণ শব্দ | ডুব দিতে ভয় করে| শিকল ধরিয়া ডুব দিলাম| ২ দিন এখানে থাকার কথা। ডাল চাল সিদ্ধ কোনমতে খাইয়া শুইলাম।

২৯শা এপ্রিল রবিবার

গঙ্গায় স্নান করিয়া কাজ করিয়া আসিলাম। পান্ডাদের কচকচালীতে কিছুই ভালো লাগে না । সধবা ও কুমারী করিলাম । এখানে রঘুনাথ জীর ,হনুমান জীর মন্দির আছে বহু পুরনো । ভাগীরথী ও অলকানন্দার সম্মিলন এইখানে ।

৩০শা এপ্রিল সোমবার

পরদিন মালপত্র লইয়া এক গাছের তলায় গ্যাঁট হইয়া বসিলাম। বাসের অপেক্ষায় রাস্তায় বসিয়া থাকিবো তবুও এবার কেদার বদ্রি দর্শন করিব, মনে এই ভাব নিয়া আসিয়াছি । বারোটায় গাড়ি আসিল। কীর্তিনগর পুল পার হইলাম বেলা ২ টায়। শ্রীনগর পৌঁছিলাম। জংশন স্টেশন। আজই রুদ্রপ্রয়াগের টিকিট পাইলে বাসে চাপিব। অনেক যাত্রী বসিয়া আছে। বৃষ্টি হইয়া বিছানা ভিজিয়াছে৷ যেখানে পাই ওয়াটার প্রুফ কিনিব। রুদ্রপ্রয়াগের টিকিট পাওয়া গেল । কার টিকিট করা ছিল ৪ জনের ,আসে নাই। তাই হঠাৎ পচা পাইয়া গেল । বহু লোক বসিয়া আছে টিকিট পায় নাই। যাক সবই ভগবানের দয়া| কোনমতে বাসে জায়গা পাইয়া পিছনের সিটে বসিয়া আছারি পিছারি খাইয়া সাড়ে চারটায় রুদ্রপ্রয়াগে গৌঁছিলাম | কম্বলিওয়ালার ধর্মশালায় জায়গা পাইলাম না। ধর্মশালার লাগোয়া এক দোকানের উপর ঘর ভাড়া পাইলাম । শুনিলাম সামনের পথ খারাপ হইয়াছে অর্থাৎ বেশি হাঁটিতে হইবে । জয় কেদার জী কি জয়।

১লা মে মঙ্গলবার

রুদ্রপ্রয়াগ | এখানে অলকানন্দা ও মন্দাকিনীর মিলন হইয়াছে। গঙ্গার ঘাট অনেক নিচে | গঙ্গায় বহু সিঁড়ি ভাঙ্গিয়া নামিতে হয়| ঘাটে দেবী গঙ্গার মন্দির আছে কাছেই শিবমন্দির আছে জল, ফুল বেলপাতা দিলাম। ঘাটে প্রবল স্রোত। রুদ্রপ্রয়াগের সবই রুদ্র-রাস্তা ঘাট কিছুই সোজা নয় । ঘরে আলুভাতে ভাত , মরিচ গুড়া, ঘি দিয়া আর তেতুল গুড় খাইলাম । মাল বাঁধিয়া গঙ্গার উপরে কাঠের পুল পার হইয়া দোকানে গেলাম। ওয়াটার প্রুফ ও ১ গজ অয়েল ক্লথ কিনিলাম। আড়াইটার বাসে রুদ্রপ্রয়াগ ছাড়িলাম | ৫ মাইল বাদ তিলওয়ারা নামাইয়া দিল। আধ মাইল হাঁটিয়া একটা বাস ধরিলাম। আবার ৫ মাইল যাইবে। অগস্ত চটিতে পৌঁছিলাম। এখানে সবাই মিলিয়া কিছু ঘুষ দিয়া বাস আরও কিছু দূর নেওয়ার ব্যবস্থা হইল । রাস্তা খারাপ তাই এই ব্যবস্থা। জয় কেদার জী, নয় তো এখান হইতে হাঁটিতে হইত । ৭টায় কুন্ড চটিতে আসিয়া পৌঁছিলাম। কাল দুই মাইল হাঁটিযা গুপ্তকাশী যাইব | সেখান হইতে হাঁটা আরম্ভ করিব | জিনিষ কিছু রুদ্রপ্রয়াগে পান্ডার বাড়ী রাখিয়া আসিয়াছি। অনেকে হাঁটিয়া আসিতেছে _ রাস্তা মাঝে খারাপ হওয়াতে এই অবস্থা। ভগবানের অসীম দয়ায় আমরা বাসের সুবিধা পাইলাম | শুনিলাম গতকাল, ৩০ শে এপ্রিল সোমবার কেদারনাথের মন্দির খুলিয়াছে।

২রা মে বুধবার

সকালে ২ মাইল চড়াই ভাঙ্গিয়া গুপ্তকাশী আসিলাম। বুঝিলাম হাঁটিয়া ২৪ মাইল পারিবনা । গুপ্তকাশীতে ঘোড়া ঠিক হইল । মনিকর্ণিকার কুন্ডে স্নান করিয়া গুপ্তদান করিলাম | সিংহের মুখে যমুনা ,হাতির মুখে গঙ্গার জল কুন্ডে পড়িতেছে। মহাদেবের মন্দির আছে। এখানের বামুন দোকানে রান্না করিবে তাই খাইব। ভাত খাইয়া আসিলাম নন্দ ও আমি দুজনে, ১ টাকা লাগিল | পোড়া ভাত ফাটা চটিতে ঘোড়া চড়িয়া আসিলাম সাড়ে পাঁচটায় । দোতলায় একটি ঘরে আশ্রয় পাইয়াছি।

৩রা মে বৃহস্পতিবার

বরাসু চটি হইয়া রামপুর চটি আসিলাম | এবেলা এখানে বিশ্রাম করিতেছি। প্যাড়া কিনিলাম। একটা বাচ্চা আর সহিস কে দিলাম | নন্দরা আসিতেছে । তুষার শুভ্র পাহাড় সামনে দেখিতেছি। সীতাপুর আসিলাম | আজ এখানেই রাত্রিবাস। কাল গৌরীকুন্ডে যাইৰ ৫ মাইল এখান হইতে ।

৪ ঠা মে শুক্রবার

সামনে বড় চড়াই। নদীর উপর বড় পুল। সোনপ্রয়াগ পার হইয়া সামনে তিন মাইল চড়াই| ঘোড়াওয়ালা যাত্রীদের খুব সাধাসাধি করিতেছে। গৌরীকুন্ডে আসিলাম। আর ৭ মাইল আছে কেদারনাথ পৌঁছিতে| মনে আশা যে কাল পৌঁছিয়া যাইব। ঠান্ডার ভয় করিতেছি। চা আমি, ঘোড়াওয়ালা ও একজন সাধু খাইলাম । এখানে তপ্তকুণ্ড আছে। গরুর মুখ হইতে খুব গরম জল পড়িতেছে।

(ডায়েরির বাকি অংশ পরের পর্বে )
প্রথম পর্বের লিঙ্ক – https://bangalinama.com/kedar-bodri-diary-part-1/


Spread the love

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *