এমবাপে-মেসি বিতর্কে ভক্তদের ভোট শুধুই ফুটবলে

এমবাপে-মেসি বিতর্কে ভক্তদের ভোট শুধুই ফুটবলে
Spread the love

সুস্মিতা গঙ্গোপাধ্যায়

কদিন আগেই হইহই! ইউরো কাপ বড় নাকি কোপা আমেরিকা?

বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এমন দুই ব্যক্তিত্ব, যাঁদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে, নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কে মাততে পছন্দ করেন তামাম বিশ্বের ফুটবল দুনিয়া। কিলিয়ান এমবাপে আদৌ লিয়োনেল মেসি বা ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর জুতোয় পা গলাতে পারবেন নাকি তা নিয়ে দ্বিধা আছে অনেকেরই। আবার কেউ কেউ তাঁকে ইতিমধ্যেই এই দুজনের উত্তরসুরি হিসাবে চিহ্নিত করে ফেলেছেন। তবে মেসির প্রতি তাঁর যে খানিক ঈর্ষাবোধ আছে, সেটা বুঝতে এখন আর বাকি নেই ফুটবল ভক্তদের। সম্ভবত রোনাল্ডোকে তিনি বেশি পছন্দ করেন, একটাই কারণে। মেসি নিজের হাতে বিশ্বকাপ তুলে নিয়ে নিজেকে যাবতীয় ধরাছোঁয়ার বাইরে করে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই। সেখানে রোনাল্ডো এই জায়গায় পিছিয়েই থেকে গেলেন। আর কে না জানে, পিছিয়ে থাকাদের প্রতি দূর্বলতা দেখিয়ে খুশি হয় মানুষ। উল্টোদিকে নিজে পিছিয়ে পড়লে ঈর্ষা! তাই মেসি যেখানে খেলবেন সেই কোপা আমেরিকাকে ছোট করে দেখিয়ে খানিক আনন্দ পেলেন এমবাপে। আর তিনি নিজে এবং রোনাল্ডো খেলছেন ইউরোতে।

তবু বোধহয় কোথাও গিয়ে তিনি খানিকটা হলেও ঠিক। ইউরো সত্যিই কঠিনতম টুর্নামেন্টগুলোর মধ্যে হয়ত এক-দুইয়ের মধ্যেই থাকবে। মেসি যদিও বলছেন, ‘যেখানে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল, তিনবারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা ও দু’বারের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ের মত দেশ খেলে, সেই টুর্নামেন্ট ছোট হয় কিভাবে?’ ছোট বলা না গেলেও, ধারে ও ভারে ইউরোর থেকে বেশ অনেকখানি পিছিয়ে। সত্যিই তো! কোপায় খেলে কারা? ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পর সেরা দেশ হল উরুগুয়ে। তারপর আসবে কলোম্বিয়া, চিলি বা মেক্সিকোর নাম। আর এবার অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জামাইকা ও কানাডাও যুক্ত হয়েছে এর সঙ্গে। তাও আয়োজক দেশ হিসাবে। কারণ, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোতেই হবে আগামী বিশ্বকাপ। তাই এবার কোপাতে কানকাকাফের যাবতীয় দেশ যুক্ত হয়েছে। শুধুই কনমেবোলের দেশ বা পরিস্কার করে বলা ভাল লাতিন আমেরিকাতে সীমাবদ্ধ নেই। যাইহোক, প্রথম দুই দল ছাড়া বাকিরা সত্যিই কি আধুনিক ফুটবলে খুব বড় বা ভয় ধরানোর মত নাম? বোধহয় না। এইসব দেশগুলো অঘটন ঘটাতে পারে, হঠাৎ হঠাৎ কিছু প্রতিভাবান তারকার জন্ম দিতে পারে। কিন্তু বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দাবিদার হিসাবে এদের কেউ ধরবে বলে তো মনে হয় না।

সেখানে ইউরোপের দিকে তাকিয়ে দেখুন। চারিদিকে শুধুই সেরাদের ছড়াছড়ি! জার্মানি, স্পেন, ইতালি তো চারবার করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এই তিন দেশের মত একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া দেশ ছাড়া রয়েছে স্পেন, ইংল্যান্ড। যারা একবার করে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন। এছাড়াও নেদারল্যান্ডস, হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া (পূর্বতন),সুইডেন ও ক্রোয়েশিয়ার মত একাধিকবার ফাইনাল খেলা দেশ। তথ্য বলছে, চ্যাপিয়নশীপের বিচারে খুব বেশি পিছিয়ে না থাকলেও রানার্স আপ হওয়ার ক্ষেত্রে উয়েফা অনেক এগিয়ে কনমেবলের থেকে। ইউরোপের দেশগুলো মিলিতভাবে ১২ বার চ্যাম্পিয়ন, সেখানে লাতিন আমেরিকা ১০ বার। কিন্তু ইউরো খেলা দেশ থেকে যেখানে বিশ্বকাপে ১৭ বার রানার্স, তখন লাতিন আমেরিকান দেশগুলি মাত্র পাঁচবার। এর বাইরেও বেশকিছু দেশ আছে, যারা যেকোনও সময়ে চাপে ফেলে দিতে পারে বহু নামীদামী দলকে। এই দেশগুলোর বাইরে ইউরো কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া পর্তুগাল, বেলজিয়ামতো বটেই, নেদারল্যান্ড, ডেনমার্ক, ওয়েসল, তুরস্ক ফুটবলে এখনও বড় শক্তি। বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল বা সেমিফাইনাল পর্যন্তও যেকোনও দিন পৌঁছে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। এছাড়া একটা সময়ে গ্রিস, রাশিয়া, যুগোস্লাভিয়াও (অবিভক্ত) ইউরো চ্যাম্পিয়নদের তালিকায় থেকেছে একটা সময়ে। তার থেকেও বড় কথা, বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর তালিকার দিকে তাকালেও এই আধিপত্যটা পরিস্কার হয়ে যায়।

এখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপে ইউরোপ থেকে ১২, কনমেবল থেকে ঠিক অর্ধেক ৬ টা দেশ।  আগামী বিশ্বকাপে সংখ্যাগুলো সম্ভবত বাড়ছে। তাছাড়া কনকাকাফও সম্ভবত নিজেদের চারের বাইরে গিয়ে একটা অতিরিক্ত স্লট পাবে আয়োজক হওয়ার জন্য। এসব থেকেই পরিস্কার, ইউরো কাপে যেসব দেশ খেলে, তারা ফুটবলে বেশিরভাগই বৃহৎ শক্তিধর দেশ। সে যতই মেসি বিশ্বের মানুষের প্রিয়তম মানুষ হোন না কেন, এই বিষয়ে তাঁর সঙ্গে একমত হওয়া যাচ্ছে না। অন্তত পুরোটা তো নয়ই।

এবার আসা যাক, সদ্য শুক্রবার বেশি রাত থেকে শুরু হওয়া ইউরো প্রসঙ্গে।  উদ্বোধনী ম্যাচে আয়োজক জার্মানী মোটামুটি ৫-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে স্কটল্যান্ডকে। এরপর তাদের আর টুর্নামন্ট ফেভারিট ধরতে কারোর আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু এটাও ঘটনা, এসব ম্যাচ দিয়ে সবটা পরিস্কার বোঝা যায় না।

কিন্তু ইউরো কাপ হবে, আর জার্মানি, ইতালি, স্পেন, বেলজিয়াম, পর্তুগাল, ক্রোয়েশিয়া, ইংল্যান্ডের মত দেশগুলো ফেভারিটের তালিকায় থাকবে না, এটা হয় না। এবারও এরাই চ্যাম্পিয়ন। গত দুটো বিশ্বকাপের সময়ে রাশিয়া ও কাতারে গিয়ে দেখেছিলাম জার্মানির মত বৃহৎ শক্তিধর দেশের পতন। গ্রুপ পর্যায় থেকে জার্মানি বিদায় নিচ্ছে, তাও আবার এশিয়ার দুই দেশের জন্য, এ ছিল সত্যিই অঘটনের বিশ্বকাপ। তবে দুটো বিশ্বকাপেই গিয়ে দেখেছি, জার্মানি দলটা ফুটবল থেকে খানিক যেন দূরে সরে অন্দরের কোন্দল সামলাতেই ব্যস্ত। শুনতে খারাপ লাগলেও সাদা-কালোর বিভেদ যেন বড় প্রকট হয়ে উঠেছিল এই সময়ে। আসলে জুরগেন ক্লিন্সম্যানের পর জোয়াকিম লো বিশ্বকাপ দিলেও তাঁর সঙ্গে থাকা হ্যান্সি ফ্লিক ঠিকঠাক সামাল দিতে পারেননি দলটাকে। তবে এবার জুলিয়ান নাগেলসম্যানের অধীনে অবশ্য আশা জাগাচ্ছেন জার্মানরা। গ্যারেথ সাউথগেটের সম্ভবত এটাই শেষ টুর্নামেন্ট। ইউরো জিততে পারলে দেশকে একটা উপহার দিয়ে যাবেন তিনি। এই কোচ এবং তাঁর ধরে রাখা প্রায় একই দলকে দেখেছি গত দুই বিশ্বকাপে। একটা নতুন প্রজন্ম নিয়ে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। সত্যি বলতে কী, বহুকাল বাদে নিজের আক্রমনাত্মক ফুটবল দর্শন দিয়ে তিনি নতুনকরে স্বপ্ন দেখানো শুরু করেন ইংল্যান্ডকে। গত বিশ্বকাপে যখন মার্কাস রাশফোর্ড-রহিম স্টার্লিংদের অঙ্ক কষা ফুটবল দেখে সমর্থকরা মনে করতে শুরু করেছিলেন ১৯৬৬’র পর হয়ত আবারও সুদিন ফিরছে তখনই ফ্রান্সের কাছে হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় সাউথগেটের দলের।  আর ২০১৮’তে তো আরও দুঃখজনক ঘটনা হল, দুই সেমিফাইনালিস্টের লড়াইয়ে বেলজিয়ামের কাছে হারের ফলে তৃতীয় স্থান হারানো। ঘটনা হল, বেলজিয়াম বা ক্রোয়েশিয়ার মত দেশগুলো এবারও কিন্তু নানা অঘটন ঘটিয়ে এই ইউরোতেও অনেকদূর যেতে পারে। ক্রোয়শিয়ার লুকা মড্রিচ বা বেলজিয়ামের কেভিন ডি’ব্রুইন কি লুকাকুদের বয়স বেড়েছে বটে কিন্তু তাঁরা এখনও ম্যাজিক দেখাতে পারেন হঠাৎ। তবে সেই ম্যাজিকে চ্যাম্পিয়নশিপ আসবে কিনা, তা নিয়ে অবশ্য ঘোরতর সন্দেহ আছে অভিজ্ঞদের। এবং আরও একজন! যিনি বৃদ্ধ হলেন। জানিয়ে দিলেন, আর বেশিদিন নেই। সময় এগিয়ে আসছে। দ্য ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো! ২০১৬’র পর অনেক জল গড়িয়ে গেছে। কাতার বিশ্বকাপে নিজের দলেই তাঁকে কীভাবে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই গল্প অনেক জায়গায় লিখেছি। হয়ত আবারও লিখব কখনও। একমাত্র পেপে ছাড়া আর কোনও বন্ধু ছিল না তাঁর পর্তুগাল দলটাতেই। তবু সেই তিনিই আজও, এবারের ইউরোতেও দলের সেরা তারকা। তাঁর দিকেই তাকিয়ে পর্তুগিজরা। তবু এই ইউরোতে তাঁর দলকে নিয়ে বিশেষ স্বপ্ন দেখছে না কেউই।

চ্যাম্পিয়নশিপের দাবিদার হিসাবে এবারও এক নম্বরেই থাকবে ইতালি। খুব কাছাকাছি থাকছে জার্মানি, ফ্রান্স ও স্পেন। খেলা আরও এগোলে বোঝা যাবে, এরা সত্যিই কতটা শক্তিধর। ততদিন নিজের নিজের পছন্দের দলগুলিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা চলতে থাকুক। চলুক রাত জাগা। আর এই রাত জাগতে জাগতেই টেলিভিশনের পর্দায় আগামী সপ্তাহের শেষে ভোর রাত থেকে হাজির হবেন মেসিরাও। তখন রাতের সঙ্গে ঢুলুঢুলু চোখে ভোরও হবে ফুটবল-সুন্দর।


Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *