ঢাকাই জামদানি : ঐতিহ্য ও আধুনিকতা

ঢাকাই জামদানি : ঐতিহ্য ও আধুনিকতা
Spread the love

লিখেছেন ওয়াজিহা তাসনিম

‘তবুও আবার রজনী আসিল,
জামদানি শাড়িখানি
পেটেরা খুলিয়া সযতনে দুলী
অঙ্গে লইল টানি।’

পল্লিকবি জসীম উদ্‌দীনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে উল্লেখ করা এই জামদানি শাড়িখানার সঙ্গে বড় যত্ন আর মায়া জড়িয়ে আছে বাঙালি নারীদের। শতভাগ বাঙালিয়ানা ফুটিয়ে তুলতে আদিকাল থেকেই রয়েছে জামদানির কদর। আবহমানকাল ধরে অধিকাংশ নারীর পছন্দের শীর্ষে এই জামদানি। জামদানির প্রতি বাড়তি আকর্ষণের কারণ এর অপূর্ব কারুকাজ সমন্বিত নকশা ও মিহি সুতো। জামদানি শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে মিহি সুতোর বুননে যেন মিশে থাকে অজস্র গল্প আর কথকতা। নকশা ও বুননপদ্ধতির বিশেষত্বের কারণে জামদানি শাড়ি অন্য সব শাড়ির চাইতে আলাদা। শাড়িপ্রেমীদের কাছে জামদানির কদর খুব ‘স্পেশ্যাল’। মসলিন ও জামদানি আমাদের সুপ্রাচীন বস্ত্রশিল্পের ঐতিহ্য এবং আভিজাত্যের প্রতীক। বিশ্বের নানা দেশে পোশাকের ইতিহাস নিয়ে লেখা ও আলোচনায় মসলিনের পাশাপাশি জামদানিরও উল্লেখ আছে। জামদানি কবে, কখন তৈরি শুরু হয়, তা স্পষ্টভাবে জানা যায় না। তবে অনেক ঐতিহাসিক ও গবেষক মনে করেন, আজকের যে জামদানি তা এ অঞ্চলের বিশ্বখ্যাত মসলিনেরই উত্তরাধিকার। সুতো থেকে তাঁত অবধি দোআঁশ মাটি ও পর্যাপ্ত তাপ এবং বৃষ্টিপাতের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী অঞ্চলে ফুটি কার্পাসের চাষ ভালো হতো। এই ফুটি কার্পাস তুলো থেকে তৈরি সুতোয় বোনা হতো মসলিন। জামদানি তৈরির জন্যও কার্পাস তুলো ব্যবহার করা হয়। জামদানি বানানোর জন্য আগে এর সুতো প্রস্তুত করতে হয়। সম্পূর্ণ শাড়ি তৈরির বেশ কয়েকটি ধাপ রয়েছে। প্রতিটি ধাপের জন্য থাকে আলাদা কারিগর।


জামদানির তাঁত ও শাড়িতে নকশা তোলা


আধুনিককালের বেশিরভাগ তাঁত হয় আংশিক, নয়তো সম্পূর্ণভাবেই যন্ত্রচালিত। কিন্তু জামদানি তৈরির জন্য বিশেষ এক প্রকারের তাঁত ব্যবহার করা হয়, যা জামদানির হস্তচালিত তাঁত নামে পরিচিত। তাঁতে কাপড় বোনার সঙ্গে সঙ্গেই চলে নকশা তৈরির কাজ। জামদানি শাড়ি তৈরির সময়ই কারিগররা জমিনের সুতোর চাইতে খানিকটা মোটা সুতো দিয়ে তাতে নকশা ফুটিয়ে তোলেন। কারিগরদের এই শিল্পনৈপুণ্যের দীক্ষা হয় নিজ পরিবারেই। ছোটোবেলা থেকেই অনেকে নকশা তৈরির হাতেখড়ি নেন। বংশপরম্পরায় একজনের কাছ থেকে পরিবারের অন্যরা নকশার কাজ শিখে নেন। শাড়ির নকশা যত সূক্ষ্ম হবে, শাড়ি তৈরি করতে ততই বেশি সময় লাগবে। সাধারণত একটি জামদানি শাড়ি তৈরি করতে তাঁতিদের সাতদিন থেকে কয়েক মাস এমনকি বছরও লাগতে পারে। জামদানি শাড়ি হাতে বোনা হওয়ায়, শাড়ির ডিজাইন হয় খুব সূক্ষ্ম, মসৃণ এবং নিখুঁত। কারিগর প্রতিটি সুতো হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বুনন করেন।

সুতোর কোন অংশই উঁচু হয়ে বের হয়ে থাকে না। জামদানির বুনন হয় মূলত কার্পাস তুলা দিয়ে। জামদানি শাড়ির সুতোগুলো সাধারণত ৩২-২৫০ কাউন্টের হয়ে থাকে। জামদানির মান মূলত কাজের সূক্ষ্মতার উপর নির্ভর করে। আর শাড়ি কতোটা সূক্ষ্ম হবে, তা নির্ভর করে এই সুতো এবং কারিগরের দক্ষতার উপর। সাধারণত যে শাড়িটার সুতো এবং কাজ যতো সূক্ষ্ম, স্বাভাবিকভাবে তার দামও ততো বেশি হয়ে থাকে; কারণ বুনতে সময় লাগে বেশি। প্রচলিত সবচেয়ে পাতলা ও এক্সক্লুসিভ জামদানির জন্য ৭০ থেকে ১০০ কাউন্টের সুতো ব্যবহার করা হয়। সূক্ষ্ম সুতোর জন্য জামদানি খুব সযত্নে ব্যবহার করতে হয়। দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য জামদানি শাড়িকে আলমারিতে ভাঁজ করে না রেখে রোলারে পেঁচিয়ে রাখতে হবে। জামদানি কখনো পানিতে ধোয়া যাবে না, সবসময় কাঁটাওয়াশ করতে হবে। এছাড়া, মাঝেমধ্যে নরম রোদে জামদানিকে মেলে দিতে হবে।

জামদানি শাড়ির প্রকারভেদ


সুতোর ব্যবহারের দিক থেকে জামদানি সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে।

১. ফুল কটন জামদানি – যেটা সম্পূর্ণ তুলার সুতো দিয়ে তৈরি করা হয়।
২. হাফ-সিল্ক জামদানি – যেখানে আড়াআড়ি সুতোগুলো হয় রেশমের আর লম্বালম্বি সুতোগুলো হয় তুলার।
৩. ফুল-সিল্ক জামদানি – যেখানে দুই প্রান্তের সুতোই রেশমের হয়ে থাকে।

কত নকশা কত নাম

জামদানি শাড়িতে রং দিয়ে নকশা করা হয় না। কারিগরদের কল্পনাকে সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়।


নকশার কাজটি যেহেতু কারিগররাই করেন, সেহেতু সেখানে দেশের প্রকৃতির কথা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। এ কারণেই জামদানির নকশায় দেশীয় ফুল-লতা-পাতার মোটিফ প্রাধান্য পায়। তবে জামদানিতে জ্যামিতিক নকশারও প্রচলন রয়েছে। নকশা অনুযায়ী জামদানি নানা নামে পরিচিতি পায়। পান্না হাজার, দুবলি জাল, বুটিদার, তেরছা, ডুরিয়া, ময়ূর প্যাঁচ, কলমিলতা, পুঁইলতা, কচুপাতা, কলকা পাড়, আঙুরলতা, সন্দেশ পাড়, শাপলাফুল, জুঁইবুটি, চন্দ্রহার, হংস, ঝুমকা, চালতা পাড়, কলসফুল, মুরালি জাল, জবাফুল, প্রজাপতি বুটি, শামুক বুটি- এরকম অসংখ্য নামে, অসংখ্য নকশায় জামদানি তৈরি হয়।


জামদানি শিল্পনগরী


ভালো জামদানি তৈরির জন্য ভালো সুতো, দক্ষ কারিগর, ঐতিহ্যবাহী নকশা যেমন দরকার তেমনি আবহাওয়াজনিত বিশেষ আর্দ্রতারও প্রয়োজন রয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের শাখানদী শীতলক্ষ্যা পাড়ের আর্দ্র আবহাওয়া জামদানি তৈরির জন্য বিশেষভাবে উপযুক্ত। ভোরবেলা সুতো প্রস্তুতের সবচেয়ে ভালো সময়। কেননা এসময় বাতাসের আর্দ্রতা বেশি থাকে। এ কারণে দেশের অন্য কোথাও জামদানি তৈরি সম্ভব হয় না। তাইতো অতীতের মসলিন এবং আজকের জামদানিশিল্প শীতলক্ষ্যাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে। ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার তারাবো ইউনিয়নের ১৪টি গ্রাম এবং সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়নের ১টি গ্রামের মধ্যে জামদানিশিল্প গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কর্পোরেশন জামদানিশিল্পকে আরও উন্নত, এর উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বিপণনে সহায়তা করার জন্য তারাবোর নোয়াপাড়া গ্রামে জামদানি শিল্পনগরী ও গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করে। জামদানির বুননশিল্প ২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর ইউনেস্কোর ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউমিনিটি’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। জামদানি এখন আর শুধু শাড়িতেই সীমাবদ্ধ নয়। কামিজ, ওড়না, পাঞ্জাবি, পাগড়ি, ব্যাগ, জুতাসহ আরও বহু ধরনের অনুষঙ্গে ব্যবহার হয়। এমনকি বসতবাড়ির আড্ডাঘরে, আসবাবে, খাবার টেবিলের বাসন-কোসনেও স্বগর্বে জায়গা করে নিয়েছে জামদানি মোটিফ।

পরিমিত এই ছ’ গজ জমিনের মধ্যেই খচিত রয়েছে শতাব্দীর ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। এখানেই জামদানি শাড়ির আলাদা নিজস্বতা। বাঙালির একান্ত নিজস্ব বলেই জামদানি শাড়ি এত অনন্য, জামদানির ক্ল্যাসিক আবেদন থাকবে চির অম্লান।


Spread the love

1 Comment

  1. Madhumita Gupta

    জামদানি তো অনেক ধরনের হয় ।এখন বাজারে এত ধরনের জামদানি আছে । সবই সুন্দর নকশায় ভরা ।তাই দাম দেখে কোয়ালিটি বুঝতে হয় । সেক্ষেত্রে ভালো জামদানি কি করে চেনা যাবে সেই সম্বন্ধে কিছু আলোচনা থাকলে ভালো হতো ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *