ঢাকাই রিকশাচিত্র: ঐতিহ্য ও যাপিত জীবন

ঢাকাই রিকশাচিত্র: ঐতিহ্য ও যাপিত জীবন
Spread the love

লিখেছেন ওয়াজিহা তাসনিম

একটা সময়ে বাঙালির বিনোদনের অন্যতম আকর্ষণ ছিলো বাংলা সিনেমা। সেসব সিনেমার মূল আকর্ষণ ছিলেন নায়ক-নায়িকারা। পর্দার সেসব আকর্ষণীয় চরিত্রের দেখা মিলত ঢাকার পথেঘাটে, দোকানে, কখনোবা রিকশায় লাগানো পোস্টারে। জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকা, চলচ্চিত্রের পোস্টার কিংবা সংলাপ- সবই স্থান পেত রিকশার পেছনে, সিট কভারে। ছোট এই যানের পুরো শরীরজুড়েই থাকত রঙিন নকশার কাজ। ফুল, লতাপাতা, পাহাড় ইত্যাদির নকশাও করা হতো নানা রং দিয়ে। এ ছাড়া তাজমহল, গ্রামবাংলা, বাড়িঘর, আলিফ-লায়লা, মুক্তিযোদ্ধা, স্মৃতিসৌধ, শেয়াল, বানর, মোরগ, প্রার্থনারত মা, মসজিদ ইত্যাদি চিত্র
অঙ্কন করা হতো। এসব নকশা বা চিত্রই পরিচিতি লাভ করে রিকশা পেইন্ট হিসেবে। সময়ের পরিক্রমায় নকশাকাররা পোশাক কিংবা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য জিনিসে নকশার মোটিফ হিসেবে বেছে নেন এ ধরনের রিকশা পেইন্ট, যা খুব দ্রুতই গ্রাহকের মন জয় করে নিয়েছে।

রিকশা পেইন্টিংয়ের বিশেষত্ব হলো যে চিত্রই আঁকা হোক না কেন- তা খুব রঙিন করা হয়, এককথায় প্রতিটা অঙ্কনের মধ্যেই হরেক রকমের রঙের খেলা দেখা যায়। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, কমলার মতো উজ্জ্বল ও চকচকে রংগুলোই প্রাধান্য পায় এ ক্ষেত্রে। ১৯৩০ এর দশকের শেষভাগে ঢাকার সূত্রাপুর ও ওয়ারী এলাকায় বাহন হিসেবে রিকশার ব্যবহার শুরু হয়। তবে তখন ছিল মানুষে টানা রিকশার যুগ। ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর ঢাকাসহ দেশের শহরগুলোতে সাইকেল রিকশা জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তখন থেকেই রিকশা পেইন্টিংয়ের শুরু।কিন্তু ফ্যাশনের খাতায় রিকশা পেইন্টিংয়ের নাম উঠে আসে বছরখানেক হলো। ধীরে ধীরে এই রিকশাচিত্র হয়ে ওঠে শিল্পকর্মের আলাদা এক ধরন। দেশের বাইরেও রিকশাচিত্রের রয়েছে দারুণ সমাদর। যেমন ১৯৮৮ সালে লন্ডনে মিউজিয়াম অব ম্যানকাইন্ডে (এখন ব্রিটিশ জাদুঘরের অন্তর্ভুক্ত) শিরিন আকবরের কিউরেটিংয়ে ঢাকার
রিকশাচিত্র নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল—‘ট্রাফিক আর্ট: রিকশা পেইন্টিং ফ্রম বাংলাদেশ’। ব্রিটিশ জাদুঘরেও বাংলাদেশের সুসজ্জিত ও চিত্রিত রিকশা রয়েছে। জাপানের ফুকুয়াকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়ামেও বাংলাদেশের
রিকশাচিত্র নিয়ে প্রদর্শনী হয়েছে এবং এ জাদুঘরে রিকশাচিত্রের একটা বড় সংগ্রহ আছে। ২০১৩ সালে জাপানের তাকামাৎসু শহরে একটি আর্ট ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশের রিকশাচিত্র বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছে। নেপালেও হয়েছে বাংলাদেশের
রিকশাচিত্রের প্রদর্শনী। তবে বাংলাদেশে রিকশাচিত্রের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনীটি হয়েছিল ১৯৯৯ সালে, ঢাকায় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। এ প্রদর্শনীতে ৫০০ রিকশাচিত্রী ও ৮৩ বেবিট্যাক্সিচিত্রীর শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছিল, যা এখন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু ফ্যাশানের খাতায় রিকশা পেইন্টিংয়ের নাম উঠে আসে বছরখানেক হলো।

রিকশা পেইন্ট নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশের অনলাইন লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড সরলার স্বত্বাধিকারী মানসুরা স্পৃহা জানান, বাংলাদেশের ফ্যাশানে রিকশা পেইন্টিং উঠে আসছেন বিবি রাসেলের হাত ধরে। তিনিই সর্বপ্রথম চশমা, কুর্তি, কামিজ ইত্যাদির ওপর রিকশা পেইন্ট করেন। এরপর অনেকে তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হন ও কাজ করা শুরু করেন। মানসুরা স্পৃহা বলেন, “আমি ২০১৬ সালে প্রথম জুতার ওপর রিকশা প্রিন্ট করি এবং সাড়া পাই। রিকশা প্রিন্টের দাম কিছুটা বেশি হওয়ার পরেও জনসাধারণের ছিল ব্যাপক আগ্রহ।” এরপর তিনি রিকশা প্রিন্টের সানগ্লাস করা শুরু করেন, যা সবার মধ্যে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পায়। গায়ে হলুদসহ বিভিন্ন উৎসবে সবাই তার কাছে রিকশা প্রিন্টের কালো সানগ্লাস নিতে শুরু করেন।

ফ্যাশান অনুষঙ্গের কোনো কিছুতে রিকশা প্রিন্ট বাদ থাকছে না। শাড়ি, ব্লাউজ, কামিজ, ওড়না, পাঞ্জাবি, স্কার্ট, টি-শার্টে তো বটে, এমনকি জ্যাকেট, জিন্স, জাম্পস্যুট-সহ ওয়েস্টার্ন পোশাকেও এখন ডিজাইনাররা রাখছেন রিকশা প্রিন্টের ছোঁয়া। পোশাক, গয়না ও ফ্যাশন অনুষঙ্গের বাইরে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসে, যেমন- কাচের গ্লাস, মগ, কেটলি, কাপ, ট্রে, কাচের বোতল, প্লেট, গয়নার বাক্স, আয়নার ফ্রেম, টি টেবিল, টুল, মোবাইল কভার, ট্রাংক, ফাইল বক্স, টিস্যু বক্স, ল্যাম্প, বুকস্ট্যান্ড, চায়ের কাপ, ছবির ফ্রেম, হেলমেট, ক্যাবিনেট, হারিকেন, মগ, টিফিন বাটি, বয়াম, নোটবুক, ফোনের কভারে রিকশাচিত্র ব্যবহার হচ্ছে। এখন তো ড্রয়িং রুমের সোফা, কুশন, পর্দা, থেকে শুরু কাপড়ের ব্যাগ, জুতো, গয়না, কপালের টিপেও দেখা যাচ্ছে রিকশাচিত্র মোটিফের ব্যবহার। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নান্দনিকতার ক্ষেত্রে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করছে এমন নকশার জিনিসপত্র। নিজেকেসহ নিজের বাড়িটিকেও নান্দনিকতা ও ঐতিহ্যের ছোঁয়া দিতে অনেকে বেছে নিচ্ছেন রিকশা প্রিন্টের সামগ্রী। অনেকে নিজের স্বপ্নের বাড়ির দেয়ালেও করাচ্ছেন রিকশা পেইন্টিং। রিকশা প্রিন্ট আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যকে বহন করে। একটা রিকশা তৈরিতে লুকিয়ে থাকে কত গল্প, কত শ্রম। সেটিই শিল্পীরা তুলে ধরছেন বিশ্বদরবারে। মানসুরা আরো বলেন, “অনেক ব্র্যান্ড এখন শুধু রিকশা পেইন্টিংভিত্তিক কাজ করছে, মানুষের চাহিদা আছে বলেই সবাই এসব কাজ করার আগ্রহ পাচ্ছে। তবে স্ক্রিন প্রিন্টিং প্রচলনের কারণে হাতে করা পেইন্টিং কদর অনেকটাই কমে যাচ্ছে। কারণ, স্ক্রিন প্রিন্টিং হাতে করা পেইন্টিং থেকে কম দামে পাওয়া যায়। হাতে পেইন্টিংয়ে আমার মেধা, শ্রম ও সময় সব দিতে হচ্ছে, বিধায় দাম একটু বেশি পড়ে যায়।

তবে আমি আশাবাদী, এই শিল্প কখনো হারিয়ে যাবে না। কারণ, বড় বড় ফ্যাশান হাউসসহ সবাই এখন রিকশা পেইন্ট
নিয়ে কাজ করা শুরু করেছেন।” বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন ফ্যাশান ব্র্যান্ড – সরলা, যাত্রা, রঙ, বিবি প্রোডাকশন, ভার্মিলিয়ন, জয়িতা ফাউন্ডেশন সহ অনেক উদ্যোক্তা কাজ করছেন এই রিকশা পেইন্ট নিয়ে। ঢাকার নন্দিত এই রিকশা এবং রিকশা পেইন্টিং ৬ ডিসেম্বর ২০২৩-এ জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। রিকশা আর রিকশাচিত্রকে এখন বিবেচনা করা হয় ঢাকা শহরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ এবং আরবান ফোক আর্টের একটি ধারা হিসেবে। আশা করা যায়, এভাবেই রিকশা ও রিকশা পেইন্টিং টিকে থাকবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে।


Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *