পৃথিবীর ছাদে পাঁচ বাঙালি (শেষ পর্ব)

পৃথিবীর ছাদে পাঁচ বাঙালি (শেষ পর্ব)
Spread the love

এভারেস্টজয়ী দেবাশিস বিশ্বাসের অভিজ্ঞতার আয়নায়

এবার ঠিক করলাম যাবো কারাকোল। একটা সেভেন সিটার গাড়ি বুক করে পাড়ি দিলাম বিসকেক থেকে পূর্ব দিকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরের সেই শহরের দিকে। পথে পরে প্রায় দুশো কিলোমিটার লম্বা সমুদ্রের মতন বিশাল এক হ্রদ ইসিক কুল (Issyk Kul)। কারাকোলে যোগাযোগ হয় গাইড অকল এর সাথে। সেখানে একদিন কাটিয়ে পরদিন চলে যাযই কারাকোল বেস ক্যাম্প। ৩ রা জুলাই বেলা সাড়ে তিনটেয় আমরা পাঁচজনই আরোহণ করি কারাকোল ন্যাশনাল পার্কের এক শৃঙ্গ – 30 Let Vlksm (৪,০৮৩ মি)। Vlksm মানে সঙ্ঘবদ্ধ করা। উচ্চারণের অসুবিধার জন্য এই রাশিয়ান শব্দের মানে আমাদের মতন করে শৃঙ্গটার নাম দিয়েছিলাম সংহতি বা Mt. Unity।

শৃঙ্গটি আরোহন করে বিকেল ছয়টা নাগাদ এসে পৌঁছলাম কারাকোল নদীর পাড়ে। এবার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নদীর ওপারে যাওয়া, কারন আমাদের তাবু রয়েছে ওপারে। পাহাড়ি নদী, স্বভাবতই ভয়ংকর খরস্রোতা। ভোর বেলায় যখন এই নদী পার করে গিয়েছিলাম তখনই জল ছিল হাঁটুর উপর। প্রচন্ড ঠান্ডা সেই জলে নেমেই পার হতে হয়েছিল ভয়ংকর বিপদজনক এই নদীকে। নদী পার হবার জন্য আগে একটা কাঠের গুঁড়ির ব্রিজ ছিল, কিন্তু কালকেই বিকেলবেলা সেই ব্রিজের খোঁজে এসে দেখে গেছি সেটা ভেঙে গেছে। কিছুটা উপরে দুটো গাছের গুড়ি ফেলা আছে। কিন্তু বেশ সরু সেই গুড়ির উপর দিয়ে অন্য পাড়ে যাওয়া প্রচন্ড ব্যালেন্সের ব্যাপার, আর কোনও ভাবে পা পিছলে নিচে পড়লে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। অন্য সময় এরকম কাঠের গুড়ির ওপর দিয়ে নদী পার হতে গেলে আমরা সাধারণত গুড়ির দু’দিকে দু’পা দিয়ে বসে হাতের উপর ভর দিয়ে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে যাই – এতে ঘোড়ায় চলার মতন পরিস্থিতি হয় বলে এই পদ্ধতিকে বলে হর্স রাইডিং। কিন্তু এখানে পাইন জাতীয় দুটো গাছ দু’পাশ থেকে ফেলা আছে বলে গুড়ির সাথে রয়েছে অসংখ্য সরু সরু ডালপালা। সুতরাং হর্স রাইডিং করে অন্য পাড়ে যাওয়া সম্ভব না।

নদী পার হতে সকালে প্রচন্ড ঠান্ডা জলে নামামাত্রই মনে হয়েছিল হাঁটু থেকে পা দুটো কেউ যেন কেটে নিচ্ছে। আর পার হবার সময় জলের নিচের পাথরে ঠোকর লেগে পায়ের পাতায় চরম ব্যাথা লাগছিল, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে হাতের ওয়াকিং স্টিকে কিছুটা সাপোর্ট দিয়ে খুব সাবধানে কোনওমতে অন্য পারে পৌঁছেছিলাম। তখনই মনে আশঙ্কা রয়ে গিয়েছিল সকালবেলাতেই যদি জলের এত টান থাকে তাহলে সারাদিনে উপরের হিমবাহের বরফ গলে যাবার পর যখন আমরা শীর্ষ আরোহণ করে বিকালে ফিরব, তখন এ নদীর কি ভয়ংকর চেহারা দাঁড়াবে? সেসময় কিভাবে পার হব সেই ভয়ংকর খরস্রোতা পাহাড়ি নদীকে?

আর এখন আরোহন শেষে ফিরে দেখি সে নদীর বিশাল আকার!! উপরে সারাদিনের তাপে হিমবাহের বরফ গলে যাওয়ায় জল বাড়ার ব্যাপার তো রয়েছেই, তার উপর গত ঘন্টা দুয়েক বেশ জোরে বৃষ্টি হয়েছে। জলস্তর তাতে আরো কিছুটা বেড়েছে।

কিন্তু বেশি ভেবে লাভ নেই, নদী পার তো হতেই হবে। এদিকে বৃষ্টি একটানা পড়ে চলেছে। তাই নদী বরাবর হেঁটে খোঁজার চেষ্টা করলাম ঠিক কোন জায়গাটা দিয়ে পার হওয়া অপেক্ষাকৃত কম বিপদজনক হবে। দেখি একটা জায়গায় নদীটা পাঁচটা আলাদা ভাগে ভাগ হয়ে অনেকটা ছড়িয়ে বইছে। নদী অনেকটা ছড়িয়ে রয়েছে বলে এ জায়গার জলের টান কিছুটা কম হবার কথা। ঠিক করলাম সেই জায়গা দিয়েই এক এক করে পাঁচটা জলধারাকে পার হয়ে যাব। সেখান দিয়েই গাইড অকল প্রথমে অন্য পাড়ে চলে গেল। নদী পার হওয়ার সময় দেখলাম ওর কোমর পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছে জলে।

জলের মারাত্মক টান দেখে ভেবেছিলাম আমাদের সাথে থাকা দড়িটাকে ব্যবহার করব, কিন্তু সেটা রয়েছে অকলের কাছে, আর সে তো সবার আগে পার হয়ে পৌঁছে গেছে অন্য পাড়ে। তাই দড়ি ছাড়াই আমরা এক এক করে নদী পার হব বলে মনস্থির করে নিলাম। সকালে লোয়ার, জুতো মোজা খুলে জলে নেমেছিলাম বলে পায়ে খুব ঠান্ডাও লেগেছিল, আর জলের নিচের পাথরে ঠোকর খেয়ে পায়ের চেটোতে খুব ব্যথা লেগেছিল। তাই ঠিক করলাম জামাকাপড় আর মোজা পরা অবস্থাতেই জলে নেমে যাব।

এক এক করে পাঁচটা জলধারা পার হয়ে এলাম, কিন্তু মাঝের দুটো জলধারা পার হবার সময় প্রচণ্ড সতর্ক থাকতে হচ্ছিল। কোমর পর্যন্ত জল, প্রচন্ড টান তার। প্রতি পদক্ষেপে নিজেকে সাহস যুগিয়ে বলে চলেছি – কোনোভাবেই পা পেছলানো যাবে না। একবার পা পিছলে গেলে এই ভয়ঙ্কর স্রোতের টান নিমেষে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

নিজেদের সাহস, শক্তি, টেকনিক, আর অবশ্যই কিছুটা কপালজোরে অবশেষে আমরা পাঁচজন একসময় পার হয়ে গেলাম কারাকোল নদী। প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগলো পুরো কর্মকাণ্ডে। তারপর প্রায় সাড়ে সাতটায় পৌঁছলাম কারাকোল বেস ক্যাম্পে আমাদের তাবুতে। সাড়ে সাতটা সময়টা শুনতে হয়তো আমাদের মনে হবে অন্ধকার এক পরিস্থিতি, কিন্তু আমরা এসেছি কিরগিজস্থানে। প্রথম দিন থেকেই দেখেছি এখানে সকাল আমাদের মতন ভোর পাঁচটায় হয়ে গেলেও সূর্য থাকে অনেক বেলা পর্যন্ত – প্রায় সাড়ে আটটার সময়তেও দেখেছি চারপাশ বেশ পরিষ্কার। রাত ন’টায় ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে এ দেশে।

পরদিন আমাদের পরিকল্পনা ছিল আরেকটি শৃঙ্গ আরোহণের, নাম – Prejevalsk (৪,২৭২ মি)। একজনের নামে এই শৃঙ্গ যিনি ছিলেন বিখ্যাত এক পরিব্রাজক, এই সমস্ত এলাকা আবিষ্কার করার কৃতিত্ব তাঁর। উচ্চারণের সুবিধার জন্য একইভাবে আমরা শৃঙ্গটার নাম নিজেদের মধ্যে পাল্টে দিয়েছিলাম আমাদের পরিব্রাজক স্বামীজীর নামে – বিবেকানন্দ, সংক্ষেপে বিবেক। কিন্তু ফের ওই ভয়ংকর কারকোল নদীকে ফের পার হতে হবে ভেবে আমরা সেই পরিকল্পনা বাতিল করে বিসকেক ফিরে আসি।

এবার প্লেনে পাড়ি দিই প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দক্ষিণের কিরগিজস্থানের প্রাচীনতম শহর ওশ (Osh) এর উদ্দেশ্যে। ৭ই জুলাই ওশ থেকে গাড়ি করে পৌঁছই পিক লেলিন এর বেস ক্যাম্প (৩,৬০০ মিটার), সাথে দুই নেপালি গাইড – ইসু রাই আর সিঙ্গি তামাং। পিক লেলিন ট্রান্স আলায় (Trans Alay) পর্বতমালার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। পরদিন উঠে যাই ৪,৪০০ মিটারের ক্যাম্প ওয়ান। ৯ তারিখ ক্যাম্প ওয়ানের পাশে শৃঙ্গ উহিন Uhin (৫,১৩০ মিটার) পাঁচজনই আরোহন করি।

১০ তারিখ উঠে যাই ৫,৩০০ মিটার উচ্চতার ক্যাম্প টু। পথে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সৌরভ নেমে যায়। ১১ তারিখ ক্যাম্প টু এর পাশে একটি অনামি শৃঙ্গ (৫,৮০০ মিটার) আমি, রাজা আর মলয় আরোহন করি। ১২ তারিখ ৬,১০০ মিটার উচ্চতার ক্যাম্প থ্রি পৌঁছই। ক্যাম্প থ্রি এর পাশেই রয়েছে পাশাপাশি দুটো শৃঙ্গ – দুই বোনের মত। তার একটার নাম Razdelnaya, উচ্চতা ৬,১৪৮ মিটার। Razdelnaya উচ্চারণটা আমাদের কাছে কঠিন মনে হওয়াতে, আমাদের মতন করে এদের ডাকতে শুরু করলাম রঞ্জনা আর সুরঞ্জনা বলে। পরের দিন আমরা চারজনই আরোহন করি রঞ্জনা। 

সেদিনই রাত আড়াইটায় রওনা দিয়েছিলাম পিক লেলিনের শীর্ষে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে। রাজা আর কিরণ পাত্র থেকে যায় ক্যাম্প থ্রি। আমি, মলয় আর দুই গাইড দুটো দলে ভাগ হয়ে রওনা দিই। প্রথমে আমি আর সিঙ্গি, পিছন পিছন মলয় সাথে ইসু। বেশ কিছুক্ষণ থেকেই চলছিল ঝড়ো হাওয়া, আর সাথে উড়ছিল তুষার। তার মধ্যেই আমরা এগিয়ে চললাম। ক্যাম্প থ্রি থেকে বেরিয়ে প্রথমে নিচের দিকে পথ। অনেকক্ষণ নিচের ঢালে নেমে যাওয়ার পর শুরু হল একটানা চড়াই। প্রায় ঘন্টাখানেক এ অনেকটা উঠে এলাম, পিছন ফিরে দেখলে চোখে পড়ছে মলয়েরা বেশ পিছিয়ে পড়েছে।

একসময় নিচ থেকে একটা সিটির আওয়াজ কানে আসতেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। চারপাশ ঘন কালো অন্ধকার – যেন আদি দিগন্ত কালো কালি লেপে দিয়েছে কেউ। অনেকটা নিচে দুটো আলোর ফুটকি। ও দুটি মলয় আর সাথের গাইড ইসু রাই এর হেড টর্চের আলো। বুঝলাম কোন প্রয়োজন পড়েছে, তাই আমাদের দাঁড়াতে বলছে। আমার ঠিক সামনেই সিঙ্গি তামাং। সিটির আওয়াজ ওর কানেও গেছে। দাঁড়িয়ে পড়েছে। আমি সামনে গিয়ে বললাম, উন লোগো কো আনে দিজিয়ে। কিছুটা সময় লাগলো ওদের আমাদের কাছে উঠে আসতে। কাছে আসার পর মলয় বলল, পায়ে একটা চোট লেগেছে, আমার চলতে অসুবিধা হচ্ছে। সবে মাত্র কিছুটাই এসেছি, পড়ে রয়েছে লম্বা এক রাস্তা। প্রচন্ড ঠান্ডা, তার উপর একটানা বয়ে চলেছে ঝড়ো হাওয়া সাথে উড়ছে তুষার কুচি। বুঝলাম বাকি পথ এভাবে ওঠা মলয়ের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তাই ওকে আর বাকি রাস্তা চলার জন্য উৎসাহিত করার চেষ্টা করলাম না। ইসুকে বললাম তোমরা সাবধানে ফিরে যাও, আমরা শীর্ষের দিকে ওঠার চেষ্টা করছি।

সারারাত প্রবল ঝড়ো হাওয়া আর তুষারের ঝাপটার মাঝ দিয়ে একটানা চরম কষ্টকর পথ পার হয়ে পরদিন, ১৪ই এপ্রিল ২০২৩ শুক্রবার, সকাল সাড়ে এগারোটায় পৌঁছই পিক লেলিনের (৭,১৩৪ মিটার) মাথায়। রচনা হয় এক নতুন ইতিহাসের। মিনিট ১৫ কাটে শৃঙ্গের মাথায়। এরপর ক্যাম্প ৩ পৌছই বেলা সাড়ে তিনটেয়। পরদিন সকালবেলা নামতে শুরু করে সোজা ক্যাম্প ওয়ান নেমে আসি বেলা সাড়ে বারোটার মধ্যেই।

১৬ ই জুলাই, ২০২৩ পিক লেনিন বেস ক্যাম্পে নেমে আসি। এরপর ওশ হয়ে গাড়িতে ফিরি বিসকেক। দেশে ফিরি ২০ শে জুলাই। এই অভিযানে সে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ছটি শৃঙ্গ আরোহণের পাশাপাশি প্রাণ ভরে দেখেছি কিরগিজস্থানের শহর গ্রাম নদী নালা, পামির মালভূমির বিভিন্ন রূপ, দেখেছি টলটলে নীল জলের সমুদ্রের মতন বিশাল হ্রদ। মিশেছে অসংখ্য মানুষজনের সাথে। পেয়েছি তাদের প্রাণভরা আতিথেয়তা। জানতে চেয়েছি তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি। যোগদান করেছি বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে আর স্বাদ নিয়েছি সেদেশের বিভিন্ন ধরনের খাবার পানীয়ের।  

আগের পর্বের লিঙ্ক- https://bangalinama.com/debasish-biswas-climb/


Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *