পৃথিবীর ছাদে পাঁচ বাঙালি (প্রথম পর্ব)

পৃথিবীর ছাদে পাঁচ বাঙালি (প্রথম পর্ব)
Spread the love

এভারেস্টজয়ী দেবাশিস বিশ্বাসের অভিজ্ঞতার আয়নায়

এ তো পুরো মিঠুন চক্রবর্তী !!! তোমাদের হিরো……

হাসতে হাসতে বলল বফা। বফা আজারবাইজানের মেয়ে। বিভিন্ন দেশের অভিযাত্রী নিয়ে ওদের বেশ বড় এক দল, তার মধ্যে ওরা তিনজন আজারবাইজানের মেয়ে – বফা, সীমা আর ঊষা। ওদের তিনজনের সাথে আমাদের খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। অপূর্ব সুন্দরী তিন কন্যা। বফা আর সীমা – প্রায় ভারতীয় দুটি নাম। অন্যজনের নামটা আমাদের কাছে কঠিন মনে হওয়াতে নামের প্রথম দুটো অক্ষরকে একটু আমাদের মতন করে পাল্টে নাম দিয়েছিলাম ঊষা। ১৪ই জুলাই পিক লেনিন আরোহণ করে পরদিন নেমে এসেছিলাম ক্যাম্প ওয়ান আর গতকাল নেমে এসেছি এখানে – পিক লেনিনের বেস ক্যাম্পে। আজ নেমে যাবো ওস। সেই মতন গাড়ির ব্যবস্থা করতে বলেছি। আমাদের চলে যাওয়ার খবর শুনেই ওরা দৌড়ে এসেছে বিদায় জানাতে। এসেই বফা প্রথমে আমাকে জড়িয়ে ধরে পিক লেনিন আরোহণের জন্য কনগ্রাচুলেশন জানালো। এরপর শুরু হল হাসি, ঠাট্টা, গল্প, আড্ডা, গান, ফটো তোলা। সেসময়ই আমাদের বর্ষীয়ান সদস্য কিরণ পাত্রকে নিয়ে সীমার ওই মন্তব্য – তোমাকে তো দেখতে একদম মিঠুন চক্রবর্তীর মতন।

কিরগিজস্থানে গত বেশ কিছুদিন ধরে রয়েছি, দেখেছি এদেশে মিঠুন চক্রবর্তী এখনো খুব জনপ্রিয় আর বলিউডি সিনেমা, গান। কখনো আমরা যে ট্যাক্সিতে উঠেছি সেই গাড়ির ড্রাইভার আমাদের ভারতীয় জানার পর গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে চালিয়ে দিয়েছে জনপ্রিয় হিন্দি গান। চলন্ত গাড়িতেই গানের তালে তালে মাঝে মাঝে স্টিয়ারিং ছেড়ে একটু নেচেও নিচ্ছে। কখনও যে দোকানে গিয়েছি তার দোকানদার তার মোবাইলে আমাদেরই কোন হিন্দি সিনেমার বিখ্যাত গানের সুরে গাওয়া ওদের ভাষার গান চালিয়ে শুনিয়েছে। শুধু পুরনো দিনের নায়ক নায়িকাই নয়, বর্তমানের হিরো হিরোইনরাও খুব পরিচিত নাম ও দেশে।

প্রতিবছরই পর্বতারোণের টানে ঘর ছাড়ি, কিন্তু এবারের অভিযান ছিল কিছুটা অন্য ধাঁচের। প্রতিবার কোনও নির্দিষ্ট শৃঙ্গ বা নির্দিষ্ট এলাকা টার্গেট করে বের হই, কিন্তু এবার ভেবেছিলাম একটু অন্যভাবে ঘুরে বেড়াবো কিরগিজস্থানের বিভিন্ন প্রান্তে, মন ভরে দেখবো সে দেশের পামির মালভূমির বিস্তীর্ণ এলাকা। দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সাধারণ মানুষের জীবন যাপন এর অভিজ্ঞতায় ঝুলি ভরে নেব; স্বাদ নেব সে দেশের খাবারের। সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টা করব পামিরের বিভিন্ন শৃঙ্গ আরোহণের। এই উদ্দেশ্যেই রওনা দিয়েছিলাম কলকাতা থেকে। প্রাথমিকভাবে আমাদের অভিযান ছিল ইন্দো-বাংলাদেশ জয়েন্ট এক্সপিডিশন। দল গঠন হয়েছিল পাঁচজন ভারতীয় আর দুজন বাংলাদেশি আরোহী নিয়ে। কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে দুই বাংলাদেশী বন্ধুর ভিসা বাতিল করে দেয় কিরগিজ সরকার। পাঁচ জনের দল হয় – মলয় মুখার্জি, সৌরভ সিঞ্চন মন্ডল, অভিজিৎ রায় (রাজা), কিরণ পাত্র ও আমি।

২৪ শে জুন আমরা কলকাতা বিমানবন্দর থেকে প্রথমে পৌঁছই দিল্লি। তারপর দিল্লি থেকে এয়ার আস্তানা এর ফ্লাইটে প্রথমে যাই কাজাকিস্তানের আলমাটি; সেদিনই আলমাটি থেকে এয়ার আস্তানা এর আরেকটি ফ্লাইটে পৌঁছে যাই কিরগিজস্থানের রাজধানী বিসকেক। বিসকেকের এয়ারপোর্ট বেশ ছোট, এয়ারপোর্টের নাম – মানস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। এয়ারপোর্ট থেকে মূল শহর প্রায় ৩০ কিলোমিটার। আগে থেকেই দু একটি এজেন্সির সাথে কথাবার্তা, ই-মেইল চালাচালি হয়েছে। তাদেরই একজন একটা সেভেন সিটারের বড় গাড়ি এয়ারপোর্টে পাঠিয়ে দিল। থাকার জন্য বিসকেকে প্রচুর হস্টেল রয়েছে। সেখানে মাথাপিছু সামান্য কিছু খরচে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। হস্টেলগুলোতে থাকার মজা এই যে, এখানে নিজেরা রান্না করে খাওয়া, জামা কাপড় কাচা ইত্যাদি নিজের বাড়ির মতন সমস্ত রকম সুযোগ-সুবিধাগুলো থাকে। প্রথম দু’দিন রাজধানী ঘুরে দেখলাম। ক্যাব বুক করার লোকাল অ্যাপ মোবাইলে লোড করে নিলাম। যখন যেখানে যেতে হচ্ছে অ্যাপ দিয়ে বুকিং করে নিচ্ছি, চটজলদি চলে আসছে গাড়ি। লোকজন মূলত রাশিয়ান আর ভাষায় কথা বলে, ইংলিশ বলা কিংবা বোঝার লোক প্রায় নেই বললেই চলে। কলকাতা ছাড়ার আগেই মোবাইলে ইংলিশ থেকে রাশিয়ান কনভার্ট করার অ্যাপ লোড করে নিয়েছিলাম। প্রয়োজনমতো সেই অ্যাপে আমাদের বক্তব্য রাশিয়ান ভাষায় পরিবর্তন করে লোকজনকে তা দেখিয়ে কাজ চালাচ্ছি। দেখলাম, সাধারণ লোক বেশ হাসিখুশি, মিশুকে। কোনও কিছু জানতে চাইলে ভাষা না বোঝার জন্য কোনও রকম বিরক্তি কারো চোখে মুখে দেখলাম না, সবাইকে বেশ অতিথিবৎসল বলেই মনে হল – সে রাস্তার পথচারী, দোকানদার কিংবা পুলিশ; এমনকি ট্যাক্সির ড্রাইভাররাও।

সবার আগে বলতে হয় আমাদের হোস্টেলের মালকিনের কথা – ২৬-২৭ বছরের বেশ সুন্দর ছিপছিপে এক মেয়ে। নামটিও ভারি মিষ্টি – ‘নারী’। আমাদের সব সমস্যার যেন মুশকিল আসান সে। তার থেকেই এক এক করে বেশ কিছু লোকজনের সঙ্গে পরিচয় হলো। খোঁজ পেলাম কিছু ট্যুর অপারেটর এজেন্সির। কিন্তু তাদের সবাই কালচারাল ট্যুর করায়, ট্রেকিং বা পর্বতাভিযান এখানে একদমই জনপ্রিয় নয়। অনেক খোঁজ করে যে দুই-একটা অ্যাডভেঞ্চার সংক্রান্ত এজেন্সির খোঁজ পেলাম, তারা সবাই এদেশে পর্বতাভিযান বলতে শুধুমাত্র পিক লেনিন বোঝে, শুধুমাত্র সেখানেই অভিযান হয়। অথচ সমস্ত কিরগিজস্থান জুড়ে বিভিন্ন পর্বতমালা রয়েছে সেসব পর্বতমালায় রয়েছে অনেক শৃঙ্গ। ভেবে এসেছিলাম, দেশ ভ্রমণের ফাঁকে ফাঁকে সেসব শৃঙ্গ আরোহণের চেষ্টা করব। সে ব্যাপারে ওদের কেউ কোনও আলোকপাত করতে পারল না। ভেবেছিলাম ভারতবর্ষ কিংবা নেপালের মতো এখানে এসব অভিযান সংঘটিত করার মতন কিছু এজেন্সি পাব যেখান থেকে জোগাড় হবে প্রয়োজনীয় গাইড এবং আরোহণের অন্যান্য সাজসরঞ্জাম। কিন্তু হতাশ হলাম। অবশেষে আক-সাই ট্রাভেলস বলে এক এজেন্সির খবর পেয়ে তাদের অফিসে ছুটলাম। আমার ভাবনায় ছিল প্রথমে বিসকেকের কাছাকাছি রয়েছে যে আলা আর্চা ন্যাশনাল পার্ক, সেখানে গিয়ে সেখানকার পর্বতমালার একটি কিংবা দুটি শৃঙ্গ আরোহণের চেষ্টা করব। এরপর যাব কারাকুল শহরে। তার কাছে রয়েছে আর এক পর্বতমালা। সেখানে আরোহণ করার চেষ্টা করে শেষে যাবো এদেশের প্রাচীনতম শহর ওস। সেখান থেকে আরও দক্ষিণে গিয়ে পিক লেনিন এবং তার সঙ্গে আশেপাশে থাকা শৃঙ্গগুলোর ভিতর যে কটা সম্ভব হয় আরোহণের চেষ্টা করব। আক-সাই ট্রাভেলসকে আমাদের পরিকল্পনা জানানোতে তারা জানালো, তারা শুধুমাত্র পিক লেনিনে আমাদের সহযোগিতা করতে পারে, অন্যান্য শৃঙ্গগুলোর ক্ষেত্রে তারা কোনওরকম সাহায্য করতে পারবে না। বুঝতে পারলাম আমাদের ‘একলা চলো রে’ নীতি নিতে হবে। ঠিক করলাম আমাদের পরিকল্পনা মাফিক আমরা নিজেরাই চলে যাব এক এক জায়গায়। সেখানে গিয়ে নিজেরাই
খোঁজার চেষ্টা করব সেখানকার লোকাল গাইড, পর্বতারোহণের সাজসরঞ্জাম। তারপর এগিয়ে যাব এক একটা শৃঙ্গের দিকে।

বিসকেক থেকে একটা সেভেন সিটার গাড়ি ভাড়া করে চলে গেলাম আলা আর্চা ন্যাশনাল পার্ক। আমাদের নামিয়ে দিয়ে গাড়ি চলে গেল। পার্কের মুখেই রয়েছে দু’একটা দোকান আর একটা গেস্ট হাউসের মতন দোতলা বাড়ি। সময় সকাল নটা। ভোরের আলো আমাদের দেশের মতন সকাল পাঁচটায় ফুটে গেলেও গত কয়েক দিনে দেখে বুঝেছি বেলা এগারোটা সাড়ে এগারোটার আগে এখানকার লোকজনদের দিন শুরু হয় না। সেই হিসাবে এখন ওদের কাছে বেশ ভোরবেলা। তাই আমরা পাঁচজন ছাড়া চারপাশে আর কাউকে চোখে পরলো না। দোকানপাটও পুরোপুরি বন্ধ। উপর থেকে একজনকে নেমে আসতে দেখে আমাদের আজকের গন্তব্য Reitzak এর পথ জিজ্ঞাসা করাতে সে জানাল, সে ওদিকে কোনওদিন যায়নি। সামনেই দেখি একটি বোর্ডে রেইটজেক যাবার পথ আঁকা রয়েছে। পথ চেনার জন্য মোবাইল ক্যামেরায় তার একটা ছবি তুলে নিলাম। উপায়ান্তর না দেখে সেই ম্যাপের দিক বরাবর হাঁটা লাগালাম।

জঙ্গলের মাঝ দিয়ে পথ। কিছুটা এগোতেই একটা মজার পরিস্থিতির সামনে পড়লাম। সামনেই একটা পাথরের উপর বাদামী রঙের অসম্ভব সুন্দর একটা কাঠবিড়ালি দাঁড়িয়ে আছে। পিছনের দু’পায়ে দাঁড়িয়ে সামনের দুটো পা তুলে দাঁড়িয়ে যেন মানুষের মতন দু’হাত তুলে আমার কাছে খাবার চাইছে। আমি ছবি তুলব ভেবে মোবাইলটা বের করার জন্য পকেটে হাত দিয়েছি, সে একদম আমার পায়ের কাছে চলে এল। তারপর পায়ের কাছে এসে আমার গা বেয়ে উঠে একদম বুকের কাছে চলে এলো। এসে সেই দুটো হাত বাড়িয়ে যেন ফের খাবার চাইলো। আমার পিঠের স্যাকের হেডে কাজু আর কাঠবাদামের দুটো প্যাকেট রয়েছে, মলয়কে বললাম চটপট বের করতে। পকেটে হাত দেওয়ার সময় কাঠবিড়ালীটা মনে হয় একটু ভয় পেল, আমার পা বেয়ে নেমে পিছনে চলে গিয়েছিল। এবার আবার দৌড়ে এসে আমার কোলে উঠে পড়ল। ওকে নিজের হাতে করে খাওয়ানোর খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু একটু ভয় লাগল যদি খিদের চোটে খাবার চট করে নিতে গিয়ে আমার আঙ্গুলে কামড় দিয়ে বসে, তাহলে আমাকে আবার নিচে নেমে টিটেনাস নিতে হবে। সেটা চিন্তা করে সামনেই মাটির উপর একটা আমন্ড রাখলাম। সেটা দেখেই সে দৌড়ে এসে তার সামনের হাত দুটো দিয়ে আমন্ডটাকে তুলে খুব সুন্দর করে টুকটুক করে খেয়ে নিয়ে আবার সামনের পা অথবা হাত দুটো উঁচু করলো, যেন বলল, আরও খাবার দাও। বুঝলাম ওর খিদে রয়েছে। আমি আর একটা আমন্ড যখন দিলাম সেটা খেলো না, ও আমাকে খুব অবাক করে দিয়ে দু’হাতে সেটা নিয়ে একদৌড়ে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে গেল। যেন মনে হল ও নিজের ঘরের কারো জন্য – ওর কোনও পার্টনার বা বাচ্চা, তার জন্য আমন্ডটা নিয়ে গেল!! এরকম পরিস্থিতিতে আমি কোনওদিন পড়িনি, মনটা দারুণ ভালো হয়ে গেল। মুহূর্তের জন্য নিজেকে এদেরই একজন বলে মনে হল, মনে হল ওই কাঠবিড়ালি আমার পূর্বপরিচিত। এই জঙ্গল, এই পরিবেশ আমার খুব চেনা। পুরো ঘটনাটাই মলয় ছবি তুলে রাখলো।

প্রায় ছয় ঘন্টা কষ্টকর ট্রেকিং শেষে পৌঁছলাম রেইটজেক। সেখানকার ট্রেকার্স হাটে আশ্রয় নিলাম। এখানে রয়েছে আলা টু পর্বতমালা। কলকাতা থেকেই ঠিক করে এসেছিলাম এই এলাকার দুটি শৃঙ্গ – মাউন্ট করোনা আর মাউন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আরোহণের চেষ্টা করব। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম ওই দুটি শৃঙ্গ অত্যন্ত দুর্গম এলাকায়, সেখানে যেতে প্রয়োজন ভালো গাইড আর পর্বতারোহণের প্রচুর সরঞ্জাম। সেসব ছাড়া ওখানে যাওয়া অসম্ভব। আর ওই দুটি শৃঙ্গ এতটাই দুর্গম এলাকায় যে অন্তত ৭ থেকে ১০ দিন প্রয়োজন এক একটি শৃঙ্গ আরোহণে। অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনও গাইড আর পর্বতারোহণের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম – কিছুই মিলল না। আমাদের পাঁচজন ছাড়া সাকুল্যে আর তিন-চার জন অভিযাত্রীকেই চোখে পড়ল, অতিরিক্ত গাইড এখানে মিলবে কোথা থেকে! দেখলাম, এখানে যারা আসে তাদের বেশিরভাগ আরেকটু এগিয়ে যে আক-সাই গ্লেসিয়ার আছে সেটা অব্দি যায়। খোঁজ নিয়ে রেইটজেকের কাছাকাছি অন্য তিনটে শৃঙ্গের সন্ধান পেলাম – মাউন্ট রেইটজেক, উচিটেল আর বকস্। তিনটে শৃঙ্গই আরোহণ হয় এই জায়গাটিকে বেস ক্যাম্প বানিয়ে। অর্থাৎ এখান থেকে এক একদিনে এক একটা শৃঙ্গ আরোহণ করে নেমে আসে এখানে। আর জানতে পারলাম, হোটেলের দেখভাল করার দায়িত্ব যার উপর ন্যস্ত, সেই রাশিয়ান ছেলে ভ্লাদিমির গাইড এর কাজ করে। এবার ওকে ধরে পড়লাম। অনেক সাধ্যসাধনার পর ও আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হল, তবে শুধুমাত্র উচিটেল শৃঙ্গের জন্য। ঠিক হলো, এখান থেকে পরদিন আমরা ভোর চারটের সময় চূড়ার উদ্দেশে রওনা দেব। সেই মতন রওনা দিয়ে প্রায় সাত ঘন্টা একটানা খাড়া উঠে ২৯শে জুন, ২০২৩ বৃহস্পতিবার বেলা এগারোটা নাগাদ প্রথম ভারতীয়
দল হিসেবে আরোহণ করি তিয়েন সান পর্বতমালার ৪,৫৪০ মিটার উচ্চতার মাউন্ট উচিটেল। উচিটেল এক রাশিয়ান শব্দ, যার অর্থ ‘শিক্ষক’; তাই এটি মাউন্ট টিচার নামেও পরিচিত। আমরা পাঁচজনই আরোহণ করি উচিটেল।

পরদিন ভ্লাদিমিরকে ফের রাজি করাতে লেগে গেলাম মাউন্ট রেইটজেক আর বকস্ শৃঙ্গে যাবার জন্য। কিন্তু কোনওভাবেই, এমনকি অতিরিক্ত ডলারের লোক দেখিয়েও ওকে রাজি করা গেল না। ওখানে থেকে কোন লাভ হবে না বুঝতে পেরে বিসকেক ফিরে এলাম। ফের নারীর হোস্টেল। শুরু হল পরবর্তী পরিকল্পনার ভাবনাচিন্তা। প্রতিদিন পরিচিতির সংখ্যা বাড়ছে, তাদের কাছ থেকে একটু একটু করে জেনে নিচ্ছি দেশটার খুঁটিনাটি। আর আমার বিভিন্ন রকম কৌতুহল মেটানোর জন্য হাতের কাছে নারী তো রয়েছেই। বেশ ছোট দেশ এই কিরগিজস্থান। আয়তন দু’লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের থেকেও কম, আর জনসংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ – তার মধ্যে এক বড় অংশ বিদেশে থাকে। জনসংখ্যার ৭৭.৫ শতাংশ মানুষ কিরগিজ, প্রায় ১৪ শতাংশ উজিবেক আর ৪ শতাংশ রাশিয়ান। দেশের নব্বই শতাংশ মানুষ মুসলিম ধর্মাবলম্বী, সাত শতাংশ খ্রিস্টান। দেশের দুটো সরকারি ভাষা – কিরগিজ আর রাশিয়ান। দেশের মুদ্রার নাম সোম, মূল্য আমাদের টাকার থেকে কিছুটা কম। বর্তমানে ১ ডলার এর মূল্য যেখানে
আমাদের ৮৩ টাকা, সেখানে এক ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যায় ৮৮ – ৯০ সোম। কিরগিজস্থান, কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান প্রভৃতি দেশগুলো একসময় সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্গত ছিল। ১৯৯০ এর দশকে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ-এর আনা পেরেস্ত্রোইকা এবং গ্লাসনোস্ট নীতির প্রভাবে এই দেশগুলো এক এক করে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে বেরিয়ে যায়। এই দেশ রাশিয়ার থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ১৯৯১ সালের ৩১ শে আগস্ট। বিসকেকের এয়ারপোর্টের নাম – মানস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। মানস কিরগিজস্থানের এক কিংবদন্তি নায়ক। প্রাচীন তথ্য অনুসারে দশম শতাব্দীর একজন কিংবদন্তি বীর মানস। তিনি এক মেষপালকের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন এবং অতি অল্পবয়সেই এক মহান যোদ্ধা তৈরি হন। নিষ্ঠুর, দুর্ধর্ষ, যুদ্ধবাজ মোঙ্গলদের মানস প্রতিহত করেন এবং কিরগিজদের অবিসংবাদী নেতা হয়ে ওঠেন। বর্তমানে মানস দা গ্রেট কিরগিজস্থানের জাতীয়তা ও সংস্কৃতির প্রতীক।


Spread the love

1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *