‘ভালো-বাসা’য় বুনোফিল

‘ভালো-বাসা’য় বুনোফিল
Spread the love

লেখা ও ছবি- সুমন ভট্টাচার্য

বাড়ির নাম ‘বুনোফিল’। যে বাড়ির নাম ভালোবাসা, যে বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নবনীতা দেবসেন আর অমর্ত্য সেনের স্মৃতি, একসময় যে বাড়িতে থাকতেন আচার্য নরেন্দ্র দেব এবং রাধারানী দেবী, সেই বাড়িতে যদি কোনো কাফে খোলা হয়, তাহলে তা অন্যতম নস্টালজিয়া বহন করবেই। বিশেষ করে আমার জন্য। এই বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে কত উঠে যাওয়া, নবনীতাদি অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর যখন তানভীরের আমন্ত্রণে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে গেলেন, সেই দিনও ওই সিঁড়ি দিয়ে হুইল চেয়ারে নামিয়ে আনার স্মৃতি আজও রয়ে গিয়েছে মনে। আসলে দক্ষিণ কলকাতার হিন্দুস্তান পার্কের মহল্লা দিয়ে হাঁটলে ডাউন মেমরি লেন দিয়ে চলা। ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বসত ভিটে, একটু দূরেই কবি যতীন বাগচির বাড়ি।

এহেন মহল্লায়, নবনীতাদির ‘ভালো-বাসা’য় যে কাফে শুরু হবে, তাকে নিয়ে আলাদা কৌতূহল থাকবে সকলের। এক বাঙালি মহিলার হাতে শুরু হওয়া ‘বুনোফিল কাফে’কে নিয়ে তাই অনেক কৌতূহল, নস্টালজিয়ায় ভেসে যাওয়া। এর সঙ্গে যদি যোগ হয় চমৎকার সব খাবারের জোগান, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। পিৎজা থেকে স্যান্ডউইচ, কন্টিনেন্টাল সব খাবারই পাওয়া যায় ‘বুনোফিল’-এ। বাইরে খোলা আকাশের তলায় যেমন বসার ব্যবস্থা আছে, তেমনই ভেতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পরিপাটি খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন। আমার যেহেতু ‘ফিশ অ্যান্ড চিপস’-এর দিকে নজর বেশি, তাই যে ক-বারই গিয়েছি সেটাই অর্ডার করেছি। কিন্তু ‘বুনোফিল’-এ ‘লাজানিয়া’ থেকে ‘গ্রিলড স্যান্ডউইচ’, হরেক রকমের পুর পেটে নিয়ে সবসময়ই হাজির থাকে ভোজনরসিকদের স্বাগত জানাতে।

এখন অবশ্য দক্ষিণ কলকাতায় ‘বুনোফিল’-এর একাধিক শাখা রয়েছে। নতুন ‘বুনোফিল’-এ হয়তো আকার এবং প্রকার বেশি, কিন্তু নস্টালজিয়ার কারণে হিন্দুস্তান পার্কের প্রথম তৈরি হওয়া কাফেটিই আমাকে বেশি টানে। হয়তো যে বাঙালি একটু স্মৃতিমেদুর, গত শতকের বাঙালি মননে সেরা প্রতিভাগুলির স্মৃতিকে আজও সযত্নে লালন করতে চায়, তার জন্য হিন্দুস্তান পার্কের ‘বুনোফিল’-এ যাওয়াটা কিছুটা ‘তীর্থদর্শন’ও বটে। গত একশো বছর ধরে যে পরিবার বাঙালি সংস্কৃতি, আধুনিক চিন্তাধারা, নারী জাগরণ ইত্যাদির ধারক এবং বাহক ছিল, সেই পরিবারের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িতে বসে তৈরি হওয়া রেস্তোরাঁয় কফির কাপে চুমুক দিলে অনেক স্মৃতির কোলাজ মাথায় আসবেই।

পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মতো, বা বলা ভালো ইতিহাস বয়ে চলা শহরগুলোর মতো কলকাতাতেও আজকাল বিভিন্ন ‘হেরিটেজ’ বাড়িতে কাফে বা রেস্তোরাঁ তৈরির চলন হয়েছে। আইকনিক রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে যেমন তৈরি হয়েছে ‘মাড কাফে’, তেমনই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের বিখ্যাত বাড়ির পাশেই ভবানীপুরে একটি বাড়িকে সংস্কার করে তৈরি করা হয়েছে ‘ভবানীপুর হাউজ’। আসলে লন্ডনে এই ধরনের কোনো কাফেতে গেলে যেমন আপনি শুধু স্যান্ডউইচে কামড় বসান না, একই সঙ্গে নস্টালজিয়াতেও ডুব দেন, তেমনই দেবব্রত বিশ্বাসের ভিটেতে কফি খেতে যাওয়া কিংবা ‘ভালো-বাসা’য় তৈরি হওয়া ‘বুনোফিল’-এ পিৎজা খাওয়া, এইসবই আসলে স্মৃতির সমুদ্রে ডিঙি নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়া। সেই নৌকায় যদি উপাদেয় খাবার আর চমৎকার সব পানীয়ের জোগান থাকে, তাহলে তো অবশ্যই ভোজনরসিকদের আগ্রহ বাড়বে। ‘বুনোফিল’ সেইজন্যেই এখন দক্ষিণ কলকাতায় আড্ডা মারার জন্য অন্যতম ‘ডেস্টিনেশন’। 


Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *