বাংলা ভাষার কী গতি হবে ? পর্ব ২

বাংলা ভাষার কী গতি হবে ? পর্ব ২
Spread the love

বিশিষ্ট ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের ধারাবাহিক

এই সমাজ ভদ্রলোক-না-ভদ্রলোকে ভাগ হয়ে যাওয়া ছাড়াও যে সমস্যা হয়েছে তা হল, ইংরেজি মাধ্যম যে সব ছেলেমেয়েরা পড়ে তাঁদের অনেকের নিজেদের বাংলা ভাষা বলার বা পড়ার সুযোগ কমে যায়, স্কুল বা অভিভাবকরাও অনেক সময় বাংলা পড়ার গুরুত্ব কমিয়ে দেন। স্কুলে বাংলা বলতে নিষেধ করা হয় বলে শুনেছি, ঘরেও ছেলেমেয়েরা বাংলা বললে বা পড়লে অভিভাবকেরা তাদের তিরস্কার করেন। তাতে বাংলা ভাষাটার প্রতি তাদের গুরুত্বের বোধ কমে যায়। সকলে এ রকম নিশ্চয়ই নন। কলকাতায় সরকারি কাজে, দোকানপাটের বা নানা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে, বাংলা বর্ণমালার ব্যবহার কম (ব্যতিক্রম নেই তা নয়), অন্তত শহরের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে বা শহরের ‘মল্ সংস্কৃতি’তে বাংলার মৌখিক বা চাক্ষুষ ব্যবহার যৎসামান্য। দামি রেস্তোরায় হোটেলে সুট টাই-পরা ওয়েটারদের সঙ্গেও আমাদের ইংরেজি বলার উদগ্র ইচ্ছা জাগে।

অর্থাৎ ইংরেজি ভাষার, লিখিত ও মৌখিক, প্রয়োগ বাংলার তুলনায় এত বেশি যে, শুধু ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেময়েদের নয়, বাংলা মাধ্যমের ছেলেমেয়েদেরও বাংলা ভাষা সম্বন্ধে একটা তুচ্ছতার বোধ জাগে। বাঙালির ক্ষেত্রে সমাজে ভাষার আধিপত্য অনুসারে একটা মূল্যক্রম দাঁড়িয়ে যায়, তাই ইংরেজি সবচেয়ে মূল্যবান, তার পরে হিন্দি, তার পরে বাংলা—এই রকম একটা হিসেবে আমরা পৌঁছে যাই। আর ‘মাতৃভাষা’ লেও যে ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে প্রায়ই দ্বাদশ শ্রেণিতে অনেক ক্ষেত্রে সারা জীবনের জন্য ছেড়ে আসতে হয় তাকে করুণা করা যেতে পারে, ভক্তিশ্রদ্ধা করা সাধারণ বুদ্ধিতে সম্ভব নয়। এই ভক্তিশ্রদ্ধার অভাব থেকেই বাংলা ভাষার নামে একটি খিচুড়ি ভাষা তৈরি হয়েছে সমাজের একটি শ্রেণির মুখে যা শুনি। তা হল বাংলা ভাষায় যথেচ্ছ ইংরেজি শব্দের মিশ্রণ। এখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলি, বাংলা প্রচুর ইংরেজি শব্দ গ্রহণ করে বাংলা করে ফেলেছে, অন্য ভাষার আধিপত্য মেনে নিলে তা করতেই হয়। আর আধুনিক সভ্যতা, জীবনযাপনের নানা উপকরণ ও উপাদান, শিক্ষার ধ্যানধারণা যখন আমরা গ্রহণ করেছি, তখন তার নামগুলিও আমরা নেব, তা স্বাভাবিখ। কাজেই যখন কেউ বলে, ওই চেয়ারটার ওপরে দাঁড়িয়ে বাল্‌বটা লাগাও’ তখন সেটাকে বাংলা বলেই মনে হয়। কিন্তু যখন কেউ বলে, আমি অ্যাকচুয়ালি আর-একটু হলেই স্লিপ করে পড়ে যাচ্ছিলুম, বাট্ ও আমাকে ধরে ফেলল লাকিলি, সো ‘থ্যাংক গড্’, আমি পড়ার হাত থেকে বেঁচে গেলাম। অ্যান্ড এ লট অফ থ্যাংক্‌স টু হিম !’ তখন মনে হয় এই বাংলাটা ক্রমশ না-বাংলার দিকে এগোচ্ছে।

সমাজভাষাবিজ্ঞানে যাকে code mixing আর code switching বলে, আমাদের বাংলা বলাতে তার সংক্রমণ বড় বেশি ঘটছে। এ রকম চলতে থাকলে বাংলাটাকে আর বাংলা বলে চেনা যাবে না। অনেকে ভাবতেই পারেন যে এ নিয়ে চিন্তার কী আছে ! কিন্তু সমাজভাষাবিজ্ঞানে এও বলে যে, ভাষার মৃত্যুর একটা প্রাথমিক পর্যায়ে ওই বুলি-মিশ্রণ আর বুলি-লম্ফন ব্যাপারটা বেড়ে যায়।
আরার সেই পুরোনো ঘ্যানঘ্যানটাও শুনিয়ে দিই, যারই অপছন্দ হোক। এতেও একটা অচেতন শ্রেণিদম্ভ ফুটে ওঠে। আমার ইংরেজির খিচুড়ি আমাকে ‘ভদ্রলোক’ হিসেবে ছাপ মেরে দেয়। তার মানে অবশ্য এই দাঁড়ায় না যে আমি ইংরেজি ভাষাটা চমৎকার জানি। প্রভাবের দ্বিতীয় স্তরে আছে হিন্দি ভাষা। তা ভারতের অন্যতম সরকারি ভাষা, ইংরেজির পাশাপাশি, আর
এখনকার কেন্দ্রীয় সরকারও নানাভাবে তার প্রভাব ও শক্তি বাড়াবার চেষ্টা করছেন। আমাদের সংস্কৃতিতে আগে থেকেই তার একটা বেসরকারি প্রভাব ছিল। হিন্দি সিনেমা, সিরিয়াল, গান ইত্যাদি আমাদের কাছে দিব্য অভ্যর্থনা পায়। এখন তো তা শিখলে ‘সুযোগ’ও বেশি পাওয়া যায়, অন্তত সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে—এটাই অনেকের ধারণা। কাজেই ওই সব স্কুলে বাংলাও তৃতীয় পছন্দ বা না-পছন্দের ভাষার পর্যায়ে নেমে এসেছে। এটা স্কুলের ষড়যন্ত্র বা অপরাধ বলা বোধ হয় অনুচিত হবে।

এই সব ঘটনা ও মনোভাবের পিছনে যে ইতিহাস আছে তাও সকলে জানেন না তা নয়। ব্রিটিশ আমলে তো বটেই, স্বাধীনতার পরেও যাকে অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা বা common school system বলে তা এই মহান্দে শে গড়ে ওঠেনি। অর্থাৎ এক সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার বিশাল ছাতার তলায় একও ও বিকল্পহীন শিক্ষা সকলে পাবে, এমন আয়োজন করা হয়নি। বহুবিধ বহিষ্করণধর্মী বা exclusive শিক্ষার সুযোগে সরকার কোনও রাশ টানেনি। অর্থাৎ নিজের খুশিমতো দাম দিয়ে নিজের সন্তানের জন্যে নিজের পছন্দসই শিক্ষা আমি কিনব—এই সুযোগ এ দেশে অবাধ থেকেছে। এই বিষয়টা পরে আমরা একটু বিশদ করি।

প্রথম পর্বের লিঙ্ক- https://bangalinama.com/banglabhasa-pabitra-sarkar/


Spread the love

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *