বিশিষ্ট ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের ধারাবাহিক
ভারত সরকার যে সকলের জন্য ওই যে এক ধরনের শিক্ষার নীতি কোনও দিন গ্রহণ করেনি, না স্বাধীনতার আগেকার ঔপনিবেশিক সরকার, না স্বাধীন দেশের সরকার, তার ইতিহাস সকলের অজানা নয়। এতে যে শ্রেণিবৈষম্য অনাহত থাকে, বা আরও তীব্র হয়, তাও শিক্ষাকর্তারা জানতেন না তা নয়। আগে থেকেই এলিট বা এলিটত্ব-অভিলাষীদের জন্য ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা ছিল, পাহাড়ি শহরের ‘পাবলিক স্কুল’গুলিতে, কিংবা শহরের সিনিয়ার কেম্ব্রিজ পাঠক্রমের স্কুলগুলিতে। মেয়েদের জন্য এক ধরনের স্কুলে, যেগুলি চার্চ-পরিচালিত বলেই বোধ হয় ‘কন্ভেন্ট’ স্কুল নামে বিখ্যাত ছিল—এক সময়ে কন্ভেন্ট স্কুলে পাত্রী পড়েছে—এই খবর দিয়ে খবরের কাগজে পাত্রপাত্রীর ইংরেজি বাংলা কলামে বিজ্ঞাপন দেওয়া হত। পরে স্বাধীন দেশের সরকার তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় বোর্ডগুলিকে যুক্ত করে, জোর করে সকলের জন্য সমান শিক্ষার প্রবর্তন করতে পারেনি। ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির বাধা ছিল, শাসকেরা নিজেদের সন্তানদের জন্যও বোধ হয় এলিটদের শিক্ষাই চেয়েছিলেন। তাই স্বাধীনতার আগে প্রতিষ্ঠিত ইউ পি বোর্ড থেকে পরে দশ ক্লাসের যে বোর্ড পরে সিবিএসই হয়ে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল, আর বারো ক্লাসের য়ে আইএসসি বোর্ড তার পরেই তৈরি হল, তার ইংরেজি মাধ্যম নীতির উপর কোনও নিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ স্বাধীন ভারতের সরকার আনতে পারেনি। গুগলে সিবিএসইর ঘোষণা দেখলাম, সে প্রতিষ্ঠান committed to equity and excellence, কিন্তু ভারতের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা equityকে কাঁচকলা দেখায়। এখন সিবিএসই ভারতীয় ভাষায় শিক্ষাদানের কথা বলছে, সেটা কোনও রাজনৈতিক চাপে কি না জানি না। ওদিকে কেন্দ্রীয় সরকার তার দুমুখো উচ্চারণ করেই চলেছে নানা কমিটি কমিশনে ‘মাতৃভাষা’য় প্রথম কয়েকটি ক্লাস শেখানো সম্বন্ধে ওষ্ঠসেবা দিয়ে। ২০২০র জাতীয় শিক্ষনীতিতেও তাই করা হয়েছে। অর্থাৎ দুটো সমান্তরাল ব্যবস্থা—ইংরেজি মাধ্যম এলিটদের বা এলিটত্ব-উন্মুখদের সন্তানদের জন্য ; আর নিম্নবিত্ত ও গরিবদের সন্তানদের জন্য মাতৃভাষা মাধ্যম। তাও ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে।
পশ্চিম বাংলার সরকারি স্কুল প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ কতকগুলি বন্ধ হয়ে গেছে, আর অন্য স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে। এ রাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা নিয়ে গর্ব কী করে করি যখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম শিক্ষক পাচ্ছে। আর কেন্দ্রও ‘মাতৃভাষা’ সম্বন্ধে যা বলে তাতে আমাদের উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। ২০২০র উচ্ছ্বাসপূর্ণ শিক্ষানীতিতেও তারা বলতে পারল না যে, নিজের ভাষায় শিক্ষার দিকে আমরা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাব, ইংরজিকেও পাশাপাশি শেখাব। তারা ক্লাস এইটের সীমা নির্দেশ করল মাতৃভাষার জন্য, একটা শৌখিন আশা প্রকাশ করল and beyond বলে। কিন্তু কবে, কীভাবে হবে তা বলল না। মনে হয়, পরের শিক্ষানীতিতেও বলবে না। তার কারণ, এই বিষম শিক্ষানীতি তাদের অব্যাহত রাখতেই হবে, নিজেদের শ্রেণি আর গোষ্ঠীর স্বার্থে। লোরেটোর ঘটনাটা এর সঙ্গে সম্পূর্ণ বিযুক্ত নয়। ওই বিশেষ শিক্ষা যারা চান তাঁদের স্বার্থেই স্কুল স্তরের উপরে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার ব্যবস্থাও বেশ পোক্ত হয়েই বসেছে এ দেশে, তাও লোরেটোর মতো কলেজও প্রচুর তৈরি হয়েছে।
আগের পর্বের লিঙ্ক- https://bangalinama.com/banglabhasha-part-2/
প্রথম পর্বের লিঙ্ক- https://bangalinama.com/banglabhasa-pabitra-sarkar/
Pingback: বাংলা ভাষার কী গতি হবে? (শেষ পর্ব) - Bangalinama