বাংলা ভাষার কী গতি হবে ? পর্ব ১

বাংলা ভাষার কী গতি হবে ? পর্ব ১
Spread the love

শুরু হল বিশিষ্ট ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের ধারাবাহিক

আসলে এ দেশের ‘ভার্নাকিউলার’গুলির কী গতি হবে ?  পুরোনো লাতিন ‘ক্রীতদাসের ভাষা’ অর্থটা ছেড়েই দিলাম ; কিংবা দশ হাজারের কম লোক বলে সে ভাষাগুলির কথাও ভুলে থাকি—দেশের বড়সড়ো বাইশটা ভাষার কী গতি হবে ? ইংরেজি মাধ্যম যদি ক্রমশ ছড়িয়ে দেশের শিক্ষা-মানচিত্রকে ঢেকে ফেলে ? তাই নিয়ে এ লেখা। অনেকে এ লেখাটাকেই ইংরেজির বিরুদ্ধে আক্রোশ-প্রচার বলে মনে করবেন, ভাববেন আমরা তাঁদের সন্তানদের ভালো চাই না। সেই রাগী আর উন্নাসিক (এই ‘বাংলা বাংলা’ করে চ্যাঁচানি আর কতদিন চালাবে এরা ?) মানুষদের জন্যও এ লেখা, যদি তাঁরা আদৌ বিষয়টা ধৈর্য ধরে, সহিষ্ণুতা নিয়ে বুঝতে চান। 

পশ্চিম বাংলায় সম্প্রতি দুটি পরস্পর সম্পর্কহীন ঘটনা খবরের কাগজে ও সমাজ-মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে বাঙালিদের মধ্যে একটি প্রবল ও পবিত্র বিক্ষোভের সৃষ্টি করে।  আমি পর পর দুটি ঘটনর উল্লেখ করছি। 

কিছুদিন আগে আড়িয়াদহের এক ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলের  প্রধান শিক্ষক এক বাংলার শিক্ষিকার চাকরি প্রত্যাহার করেন। তার কারণ, স্কুলটিতে বাংলা পড়ার কোনও ছাত্রছাত্রী এবার ভর্তি হয়নি। এই বরখাস্ত-পত্র ঘিরে সমাজ মাধ্যম ও সংবাদপত্রে খুব তোলপাড় হয়ে যায়।  চিঠিটির ভাষা সংগত হয়নি, কিন্তু তা এ নিবন্ধে অপ্রাসঙ্গিক। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ইংরেজি চিঠি যে ইংরেজি কেতাদুরস্ত হবে, তা নাও হতে পারে।  সুখের বিষয়, সে শিক্ষিকাটিকে আবার ফিরিয়ে নিয়েছে ওই স্কুল।  স্থানীয় প্রভাবশালী এমএলএ কীভাবে তাঁদের মত পরিবর্তনে সাহায্য করলেন, তাও আমাদের আলোচ্য নয়, যেমন আলোচ্য নয় বাংলা পড়ার ছাত্র নেই যে-স্কুলে,  বাংলার শিক্ষিকাকে দিয়ে এখন সে স্কুল কী করাবে। 

আরও একটি ঘটনা একটু পরেই এর সঙ্গে জুড়ে গেল। এবারে দ্বাদশ শ্রেণির ফল বেরোবার পর যখন ছেলেমেয়েরা কলেজে ভর্তি হওয়ার উদ্যোগ নেব, তখন লোরোটো কলেজ থেকে একবি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হল যে, ওই কলেজে যেন ভারতীয় ভাষা মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হওয়ার জন্য দরখাস্ত না করে। কারণ, সে সব মাধ্যমে পড়ানোর কোনও ব্যবস্থা সেখানে নেই।  তাদের গ্রন্থাগারে শুধু ইংরেজি পত্রপত্রিকা ও বই আছে, ফলে ভারতীয় ভাষার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। 

প্রথম ঘটনাটা থেকে একটা দীর্ঘদিনের অতি পরিচিত সামাজিক প্রবণতা বেরিয়ে আসে, যা বাংলাভাষার পক্ষে, বা ইংরেজি ছাড়া যে-কোনও মাতৃভাষার পক্ষে, খুব সুসংবাদ বহন করে না।  তা হল, এক শ্রেণির অভিভাবকের যে কোনও মূল্যে সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর, এবং বাংলা বা মাতৃভাষা না পড়ানোর, জন্য উদগ্র ব্যগ্রতা।  তার জন্য তাঁদের অপরাধী করার আগে তার বহু বহু আলোচিত কারণগুলিও বুঝি আমরা।  এক নম্বর কারণ, তাঁরা ভাবেন, সে ভাবনা ভুলও নয় যে, ইংরেজি ভালো বলতে-লিখতে শিখলে তাঁদের সন্তানদের নানারকম সুযোগ খুলে যাবে। একটা সুযোগ, উচ্চশিক্ষায়, সেটা এদেশে হোক, বা বিদেশে হোক।  অথাৎ, ইংরেজি শিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে ঘরে-বাইরে, হয়তো সারা পৃথিবীতে সুযোগ এনে দেয়।  আচ্ছা, সকলে হয়তো উচ্চশিক্ষার কথা অতটা ভাবেন না।  তাঁরা যে ব্যাপারটা বেশি করে দেখেন তা হল, আমাদের সমাজে আর-একটা সুযোগ, শিক্ষার পর ‘ভদ্রলোকের’ যোগ্য চাকরিবাকরি পাওয়াতে—যাকে তাঁরা ‘সাফল্য’ বলে মনে করেন। ইংরেজি নিঃসন্দেহে বিশ্বজোড়া সাফল্যের ভাষা।  তবে সকলের ক্ষেত্রে সুনিশ্চিত সাফল্য প্লেটে করে তুলে দেয় কি না, তা আমরা জানি না।  তৃতীয় সুযোগ বা অর্জন, ‘ভদ্রলোকে’র মর্যাদা, যা তাঁদের সন্তানকে ইংরেজি না-জানা ‘অশিক্ষিত’ (আসলে ‘নিরক্ষর’) চাষি, মজুর, বাজারের বিক্রেতা আর শ্রমজীবী থেকে আলাদা করে দেবে।  জাত-পাত ক্লিষ্ট এই সমাজে ‘ভদ্রলোক’ হওয়া একটা প্রাণপণ লক্ষ্য। কারণ, ‘ভদ্রলোকেরা’ সম্মানিত হয়, আর ‘না-ভদ্রলোকেরা’ (আগে অন্য একটা শব্দ ব্যবহার করা যেত) লোকব্যবহারে তত সম্মান পায় না।  ভদ্রলোকেদের অনেকেই এখনও তাঁদের ‘তুই’ বা ‘তুমি’ করে কথা বলেন, আরও নানাভাবে অবজ্ঞা দেখান।  তাঁরা সেটা বোঝেন বলে তাঁরাও তাঁদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর জন্য প্রাণপণ করেন, সে স্কুল যেমনই হোক।  আর ওই সব স্কুলে তো ছেলেমেয়েরা শুধু ভাষা শিখবে না, তারা একটা ‘সংস্কৃতি’ বা জীবনাদর্শের মধ্যে প্রবেশ করবে।  তা হল এক ধরনের সাহেবিয়ানা, সুট-বুট-কোট-টাই পরা বাদামি ইংরেজ বা আমেরিকান।  এটা পুরোটা নেতিবাচক নয়।  এই সংস্কৃতি তাকে প্রাদেশিকতা থেকে বাইরে পৌঁছে দেয়, হয়তো পৃথিবীর নাগরিকত্ব দেয়।  আবার সেই সঙ্গে গায়ের রং যাই হোক, ওই চেহারা, ভাষা আর আচরণের সামাজিক মর্যাদা যেমন আমাদের সমাজে, তেমনি অন্যত্রও, অনেক বেশি।  তাই দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠীতে এই শিক্ষা বহুদিন ধরে বহুবাঞ্ছিত হয়ে আছে।  তথাকথিত ভদ্রলোক সমাজে যারা এখনও পৌঁছোতে পারেননি তাঁরাও তাঁদের সন্তানদের জন্য এই শিক্ষা প্রার্থনা করেন।  এতে অন্যায় বা অপরাধের কিছু নেই।  সমাজের সিঁড়ি বেয়ে আমরা সকলেই উঠতে চাই।  ঘুষ-তোলাবাজির বা অপরাধের একটা লোভনীয় বিকল্প পথ আছে, কিন্তু সেটা সব সময় নিরাপদ নয়।  বেশিরভাগ লোক শিক্ষাকে এখনও একটা বৈধ পথ হিসেবে বেছে নেয়।  তবে এ রাজ্যে শিক্ষা এখন যে অবস্থায়, তাতে তা কতটা ব্যক্তি ও সমাজের উন্নয়নে সাহায্য করবে তা বলা মুশকিল। 

অবশ্যই অনেকে সমাজের ওই বিচ্ছেদ—এই ভদ্রলোকে না-ভদ্রলোকে ভাগ হয়ে যাওয়াটাকে একটা গুরুত্বহীন আর স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই মনে করেন, তাঁদের মধ্যে না-ভদ্রলোকেরাও আছেন।  আর প্রথম দলের মধ্যে অনেকেই এ জন্য ইংরেজি শিক্ষাকে দায়ী করেন না। 

আবার অনেকে হয়তো এও স্বীকার করতে চাইবেন না যে, ইংরেজি শিক্ষার জন্য ভারতের সাক্ষরতা ব্যাহত হয়েছে, শিক্ষার অঙ্গনে এখনও সব মানুষ এসে পৌঁছোতে পারেননি।  ২০২১-এও ২২ শতাংশের কিছু বেশির ভাগ ভারতীয় নিরক্ষর, এখনও পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ নিরক্ষর এই মহান ভারতে আছেন। 

আমি কোনও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাই না।  কিন্তু এই খবরগুলি সম্বন্ধে সকলকে অবহিত করতে চাই যে, ১৯২৯ সালে প্রথম বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে মারাঠি ভাষায় স্কুল শিক্ষা (ইংরেজির বদলে) অনুমোদিত হয় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তা চালু হয় ১৯৪০ থেকে।  এর অনেক আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথের মাতৃভাষায় শিক্ষাবিষয়ক নিবন্ধগুলি প্রকাশিত হতে শুরু করেছে—প্রথম প্রবন্ধটি প্রকাশিত হচ্ছে  ১৮৯২ সালে।  ‘শিক্ষা’ বইটি প্রকাশিত হবে ১৯০৮এ।  ১৯১০-১২ থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক এবং ‘মাতৃভাষা’ নির্ভর করার আন্দোলন শুরু হয়েছে। উনিশ শতকের মধ্যলগ্নে আসার আগেই মহারাষ্ট্রে জ্যোতিরাও ফুলে অন্ত্যজ শ্রেণিদের জন্য মারাঠি মাধ্যমে প্রাথমিক খুলেছেন, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলও নানা অধিবেশনে স্কুলশিক্ষা নিজের ভাষায় করার বিষয়ে প্রস্তাব নিচ্ছেন।  গান্ধিজির নঈ তালিমের প্রকল্পেও ‘মাতৃভাষা’য় শিক্ষা গুরুত্ব পাচ্ছে।  রবীন্দ্রনাথ, গান্ধিজি সহ অনেকেই ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ’ কথাটি উচ্চরণ করছেন। তারই সম্মিলিত চাপে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে স্কুলশিক্ষাকে ইংরেজি মাধ্যম থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার। ইংরেজ সরকারও ১৯৩৭ নাগাদ এ বিষয়ে সায় দেয়। নিশ্চয়ই স্কুলের সংখ্যাও বাড়ছে দেশে, কিন্তু তবু ভাষামাধ্যেমে শিক্ষার এই সুযোগ খুলে যাওয়াকে সাক্ষরতার হঠাৎ বৃদ্ধির সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেখতে পারি না।  মনে রাখতে হবে, এখনও আমাদের দেশে সাক্ষরতার হার পৃথিবীর বহু দেশের চেয়ে কম, উজবেকিস্তান (৯৯.৯৯), জাম্বিয়া (৮৬.৭৫), কেনিয়ার (৮১.৫৪) চেয়েও।

পরের পর্বের লিঙ্ক- https://bangalinama.com/banglabhasha-part-2/


Spread the love

1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *