ভবন ও ভাবনার ভুবনে

ভবন ও ভাবনার ভুবনে
Spread the love

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এস এম মাসুম বিল্লাহর লেখায়

বেড়ে উঠেছি আগেই। কিন্তু বড় হয়ে ওঠা হলো কই? তা না হলে কলকাতা যেতে এদ্দিন লেগে গেল আমার? সত্যি বলছি, এই চালশে বয়সে এসে মাত্র গত বছর জুলাইতে আমার প্রথম কলকাতা যাওয়া। অবশ্য শুরু হয়ে এরই মাঝে কলকাতা বেড়ানো হয়ে গেলো তিন-চারবার। একবার তো ঈদের সময়টাও থাকা হলো। খুব যে ঘুরেছি তা নয়। তবে অন্য অনেক ব্যাপারের সঙ্গে প্রাপ্তি হলো “বাঙালিনামার” ধারণার সাথে পরিচিত হওয়া। এবং অনেকটা অনুরোধে ঢেঁকি গলধঃকরণের মতোই এপার-বাঙলা ওপর-
বাঙলার কিছু মিল-অমিলের যোগ, ইতিহাসের গলিপথ দিয়ে হেঁটে গিয়ে পুরোনো স্মৃতিগুলি পুনরায় সামনে আনতে বসে গেলাম।

কী দিয়ে যে শুরু করি! ভাবলাম বাঙালির যে অবিভাজ্য সত্তা এবং পরবর্তীতে এর ভাগ, অভাগ এবং ভাব-অভাব ও স্বভাব এসব নিয়েই গল্প বানাবো। বাউল শাহ আব্দুল করিম গাহেন: “সাধে সাধে ঠেকছি ফাঁদে গো, ও সখি দিলাম ষোলো আনা! তো সেই ষোলো-আনা দেবার মানসে আজ বলি আমার কলকাতা বেড়ানি ও বাংলাদশের জন্ম-জড়ানির গল্প। আসবে কিছুটা ইতিহাস ও আত্ম-জিজ্ঞাসা এবং একেঅপরকে বোধে নেবার উপলক্ষ্যও।

মার্কিন চলচ্চিত্রকার মাইকেল ক্রিসটনের একটি দারুণ কথা আছে: “তুমি ইতিহাস জাননা, মানে ধরে নেয়া যায় তুমি কিছুই জাননা, তুমি সেই পাতার মত যে জানেনা যে সে একটা গাছের অংশ।” তাই ‘হঠাৎ বৃষ্টির’ এক মেদুর সন্ধ্যেবেলা সহধর্মিণী ইরানি সমভিব্যাহারে চলে গেলাম বাংলাদেশের আইনি জন্মজঠরে। শ্রী অরবিন্দ ভবনই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়। সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলো পরিকল্পিত ও সরকারের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। বাড়িটি আমাদের ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের অনুরোধে বাংলাদেশকে দিয়েছিলেন ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। এ লক্ষ্যে জেনারেল কেএফ রুস্তমজি (বিএসএফ প্রধান, ১৯৭১) দুই তিনটা বাড়ি দেখিয়েছিলেন এম আমীর-ঊল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমদদেরকে। এই প্রথম বাড়িটাই তাঁদের পছন্দ হয়েছিল। আমীর-ঊল ইসলাম বাংলাদেশের
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রধানতম প্রণেতা। বিখ্যাত আইনজ্ঞ সুব্রত রায় চৌধুরীকে ওই ঘোষণাপত্রের খসড়া দ্যাখালে তিনি বিস্ময়মথিত প্রশংসা করেছিলেন ব্যারিস্টার ইসলামের।

সে আলাদা গল্প। কলকাতা এসে আমার অরবিন্দ ভবনটি দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। পরান ‘সে যে মানে না!’ তাই দেখতে গিয়েছিলাম। ৮ নম্বর থিয়েটার রোড, যার এখনকার নাম শেক্সপীয়র সরণি। সেখানে বাড়িটি এখনও রয়েছে। তবে সেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা প্রবাসী সরকারের কোনও স্মৃতি নেই। তাহলে কি হবে? মুক্তিযুদ্ধতো আমার- আমাদের –সাত কোটি বাঙালির অন্তরে, তাই নয়? সাত কোটি বাঙালির ‘প্রাণের আবেগ আজ পুষ্পিত সৌরভ’! তাই অনুভব করলাম ওঁদের — কল্পনার চোখে দেখতে পেলাম খাকি পোশাক পরা মোটা ফ্রেমের চশমা চোখে নয় মাস নির্ঘুম ১৫০০ টাকা বেতনের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নিবিষ্ট মনে কাজ করছেন। আহা তাজউদ্দীন আহমদ! রাজনীতির ঋষি! একটা খাট, একটা টেবিল, একটা চেয়ার, তিন টাকা দরের একটি মশারি- এসব দিব্য চোখে ভাসলো। কল্পনায় দেখলাম ৮ এপ্রিল ১৯৭১-এর কলকাতার এক বৈঠকে একটা রিভোল্যুশনারি কাউন্সিল করার বিষয়ে শেখ মণির তেজস্বী যুক্তি তখনকার তরুণ শ্মশ্রুমন্ডিত ব্যারিস্টার আমীর কি সাবলীলভাবে আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টি দিয়ে খণ্ডন করে একটা জনগণতান্ত্রিক আইনানুগ সরকার গঠনের যুক্তি দিলেন, এবং তা তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ অন্যদের স্বস্তি এনে দিলো।

বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স– বিএলএফ (মুজিব বাহিনী– শেখ মণি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ এরা) যুবারাও সেটা মেনে নিলো বলে মনে হলো। সে কাহিনীর অবশ্য আরো বাঁক আছে। সেদিকে যাব না । এক সাক্ষাৎকারে ব্যারিস্টার ইসলামকে বলতে শুনেছি, তিনি তাঁর জীবনের সেরা আইনি যুক্তি দিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন সেদিন। তাজকন্যা শারমিন আহমদ তাঁর এক লেখায় বলেছেন যে, মুক্তিযুদ্ধকালীন একটা আইনানুগ সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা প্রথম অনুভব করেন তাজউদ্দীন আহমদ ৩০ মার্চ ১৯৭১ ভারতে যাবার পথে এক ব্রিজের নিচে বসে বসে। আমি এসব কথার দোহাই টেনে লেখা ভারী করতে চাইনা। ভবনটির এদিক-ওদিক তাকাই। জিজ্ঞাসু চোখ কথা বলে ওঠে ওখানে থাকা মানুষগুলোর সঙ্গে। মনে
পড়লো হারমান হেসের একটি কথা। জার্মান ঔপন্যাসিক হারমান হেসের মতে, ইতিহাস পড়া মানে নিজেকে দ্বন্দ্বে সমর্পণ করা, তবুও এর মাধ্যমে নিজের চিন্তাকে শৃঙ্খলা ও বিশ্বাসে ফেরানো যায়। হাঁটতে থাকি ইতিহাসের ভবন ও ভাবনার আলপথ দিয়ে।

৮ নম্বর থিয়েটার রোডের ভবনের দোতলায় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সেনা প্রধান কর্নেল এমএজি ওসমানি, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী বসতেন। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামারুজ্জামানের দপ্তর ছিল কলকাতার অন্য একটি বাড়িতে। আর এই ৮ নম্বর বাড়ির নীচের তলায় একটা বড় ঘরে বসতেন ও অন্য আরেকটা ঘরে থাকতেন আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। আমার মনে হলো বর্তমান লাইব্রেরিতেই তাঁর ঘরটা ছিল। দোতলার বড় হলঘরটাতে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকতেন নানা সেক্টর থেকে নির্দেশ নিতে আসা মুক্তিযোদ্ধারা। পিছনের দিকের বড় বারান্দায় বসতেন কিছু অফিসার – যাঁরা পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস থেকে বেরিয়ে চলে এসেছিলেন। আগেই বলেছি, এই বাড়িটি আদতে ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের
বীর অরবিন্দ ঘোষ (১৮৭২-১৯৫০), যিনি পরবর্তীতে ঋষি, যোগী ও দার্শনিক অরবিন্দ নামে স্বখ্যাত তাঁর মামা বাড়ি। সেখানেই জন্ম তাঁর। শ্রী অরবিন্দের বাবা আমাদের এপারের জেলা রংপুরে কাজ করতেন একসময়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ কলকাতা ছেড়ে নিজেদের দেশের দিকে রওনা হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা। এর পরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায়ের সময়ে ১৯৭২ সালে ইন্দিরা গান্ধী একটা আইনের মাধ্যমে অরবিন্দ ট্রাস্টকে
বাড়িটি দিয়ে দেন। এখানে শ্রী অরবিন্দের দেহাবশেষ রয়েছে। তাঁর ভক্তরা এখানে নানান অনুষ্ঠানাদি করেন। তাঁর স্মৃতিতে অর্ঘ্য নিবেদন করেন।

বঙ্গবন্ধু দুহিতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কাছে বাড়িটি ফেরত চেয়েছিলেন। কিন্তু শ্রী অরবিন্দের প্রতি তাঁর ভক্তদের ভাবাবেগ উপেক্ষা করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষে শেখ হাসিনার সেই অনুরোধ রাখা কঠিন। তা বুঝতেও অসুবিধা হয়না। তবুও একটা কিছু সমাধান চিন্তা করলে বের হতেও পারে। যতদূর জানি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখনো এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। একটি স্মৃতিকক্ষ বা কর্ণার, যেমন ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলে আছে বঙ্গবন্ধু কর্ণার– সেরকম কিছু করে সমাধানের চেষ্টা চলছে। মাঝে মাঝে ভাবি, কত উদারতা থাকলে একটা দেশের মানুষ একটা প্রবাসী সরকারের অফিস পরিচালনা করতে দিতে পারে! সেসব গল্প মুরব্বিদের স্মৃতিতে নিশ্চয় মহীরুহের মতো জমা আছে। বিপদে দেশ-কাল ভেদ কী? কাজী নজরুল সুন্দর করে গেয়েছেন জয়গান: “নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।” বাংলাদেশও অবশ্য পশ্চিম বাংলার এই অবদানকে ভোলেনি। যুদ্ধ শেষের পরে ঢাকা স্টেডিয়ামে মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বলেন: “আমি যদি মিসেস গান্ধী, ভারতের জনসাধারণ, ভারতের সামরিক বাহিনী, কলকাতা আর পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ, আসামের জনসাধারণ, ত্রিপুরার জনসাধারণ,
মেঘালয়ের জনসাধারণকে মোবারকবাদ না জানাই তাহলে অন্যায় করা হবে। তাঁদের আমি আপনাদের পক্ষের থেকে, সাত কোটি দু:খী বাঙালীর পক্ষের থেকে ধন্যবাদ জানাই। এক কোটি লোককে তারা খাবার দিয়েছে।” ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ কলকাতার ব্রিগেড প্যারেডে দশ লক্ষ মানুষকে সামনে নিয়ে এবং শ্রীমতি গান্ধীর পাশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখানেও ওই কৃতজ্ঞতার প্রকাশ আছে।

অরবিন্দ ভবনটি থেকে বেরিয়ে আসার সময় মনে হলো কে যেন ডাকছে ! আসলে ও এক বিভ্রম! হতে পারে ইতিহাস পেছন থেকে কথা কয়, ডাকে। একটু আনন্দও হলো। বাংলাদেশ শব্দটার ইংরেজি বানানে একটা GLAD লুকিয়ে আছে। আনন্দ ও সৌন্দর্য আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকে। একে খুঁজে নিতে ক’জন পারে? রবীন্দ্রনাথ গাহেন: “তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে, মরি হায় হায় রে”….


Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *