আমেরিকা থেকে সিলভীয়া পান্ডীত
আচ্ছা বলুন দেখি, বাংলাদেশের কোটা আন্দোলন যে আসলে সরকার পতনের আন্দোলন, এটা যখন বাংলাদেশের প্রাক্তন সরকারই বুঝতে পারেননি, তখন আমরা সাধারণ মানুষ কীভাবে বুঝবো?
আওয়ামি লিগ নেত্রী যখন রাতদিন পরিশ্রম করে দেশের উন্নতি করছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়নে ব্যস্ত, তখন আওয়ামি লিগের বেশিরভাগ মন্ত্রী ও নেতারা আখের গোছানোর কাজে তৎপর। তাই ওরা জানতেও পারেনি গত বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের যুব সমাজে ঢুকে একদল বাংলাদেশ বিরোধী মানুষ সরকার পতনের জন্য কাজ করছে ।
গত পনেরো বছরে বাংলাদেশ যেমন ঝলমলে হয়েছে, তেমনি আওয়ামি লিগের প্রচুর নেতাদের দেশে এবং বিদেশে টাকার পাহাড় গড়ে উঠেছে। এটা দেশের সাধারণ মানুষ কিছুতেই মানতে পারছিল না। আর সে কারণেই সব রাগ গিয়ে পরেছিল নেত্রী ও দলের মুখ শেখ হাসিনার উপর। শেখ হাসিনার সরকার কেন তাঁর দলের লোকদের এ বিষয়টা দেখেও না দেখার ভান করে ছিলেন তা সত্যি আমার বোধগম্য নয়।
শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর বঙ্গবভনে যে লুটতরাজ হয়েছে তা দেখে একটা ব্যাপার আমি বুঝেছি, ব্যক্তি শেখ হাসিনা খুব সাধারণভাবে থাকতেন আর প্রকৃতি ও পশুপাখি ভালবাসেন তিনি। উনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে বাংলাদেশের উন্নতির জন্য ভিক্ষা করে টাকা নিয়ে আসতেন আর সে টাকা লুটেপুটে খেতো স্বার্থান্বেষী কিছু ব্যক্তি । উনি কেন কঠোর হতে পারেননি ওঁর সঙ্গে থাকা লুটেরাদের সম্পর্কে তা যদি জানতে পারতাম লেখাটা লিখতে আমার অনেক সুবিধা হতো। আমি তো রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতো বিশ্লেষণ করতে পারব না…. কিন্ত সুদূর প্রবাসে থেকেও ফোনে, টিভিতে, সামাজিক মাধ্যমে আমার দেশ, আমার সোনার বাংলার পরিস্থিতি দেখে নিরাপদ দূরত্ব রেখে চুপ করেও তো থাকতে পারছি না।
আপনারা মনে করে দেখুন, গত পনেরো বছরে সাধারণ জনগণও অনেক ধনী হয়েছেন। মধ্যবিত্তদের হাতেও এখন অনেক টাকা; তাঁরা চিকিৎসা করাতে সিঙ্গাপুর যান। দামি গাড়ি চড়েন, দামি বাড়িতে থাকেন। একটু মন খারাপ লাগলেই কাছের কোনও রিসর্টে বেড়াতে যান। তাঁরাই আবার এই শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় তোলেন বিভিন্ন আড্ডায় ! হায়রে বাঙালি!
ঝলমলে রাস্তাঘাট, মোড়ে মোড়ে দামি দামি কফি শপ, শপিং মলগুলো লোকে লোকারণ্য, অত্যাধুনিক সিনেমা হল, চোখ ধাঁধানো খাবার রেষ্টুরেন্ট, বিউটি পার্লারগুলোতে উপচে পড়া ভিড়, মেট্রো রেল, পদ্মাসেতু, এক্সপ্রেসওয়ে , গ্রামের রাস্তাঘাটগুলোতে গাড়ি চলে সহজে, রিক্সাওয়ালার হাতে স্মার্ট ফোন, বাড়ির কাজের বুয়ার হাতেও মোবাইল, বাড়িতে রঙিন টেলিভিশন এবং ফ্রিজ এসব দেখে আমি কী করে বুঝব, বাংলাদেশের মানুষ ভাল নেই! বাংলাদেশের মানুষের মনে এত রাগ আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সুযোগ্য কন্যা অত্যন্ত সাহসী শেখ হাসিনার উপর ?
পুরো বিশ্ব দেখেছে শেখ হাসিনার সরকারের পতনে বাংলাদেশের নির্লজ্জ বাঙালিরা কী ভীষণ নগ্ন উন্মাদনায় মেতেছিল। এরপর আর কি কোনওদিন আমি গর্ব করে বলতে পারব, আমি বাংলাদেশী আমেরিকান? আমার সন্তানেরা বন্ধুদের কাছে গর্বে উচ্ছ্বাসে ভালবাসায় নিজেকে আর কখনো বাংলাদেশী বলে পরিচয় দিতে চাইবে? আমরা বেইমান জাতি, আমরা ইতিহাস মুছে ফেলতে পারি কারণ আমরা বাংলাদেশের ঐতিহ্যর পরোয়া করি না। আমরা আমাদের জাতির পিতার মূর্তিকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে ঝাড়ু দিয়ে পিটাতে পারি। আমরা আমাদের মা সমান প্রধানমন্ত্রীর অন্তর্বাস নিয়ে কুৎসিতভাবে খেলতে পারি। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের মূর্তি ভেঙে ফেলে ১৯৭১ সালে তাঁদের অবদানকে অস্বীকার করতে পারি। কি বর্বর আত্মঘাতী জাতি আমরা!
মনে তো প্রশ্ন আসেই, এত বড় ছাত্র আন্দোলনের টাকা কোথা থেকে এসেছে? তাহলে কি আমরা ধরে নেব, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতের সাহায্যের কাছে যে অপশক্তি হেরে গিয়েছিল, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে বাংলাদেশের কিছু দামাল ছেলের কাঁধে বন্দুক রেখে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে তারাই?
আরো একটা প্রশ্ন রাখি। বৃহস্পতিবার একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হল তার বৈধতা কতটা? শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশের সংবিধান থেকে তত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ঘোষণা করেছে অনেক বছর আগে, তাই বাংলাদেশে কীভাবে সংবিধানের তোয়াক্কা না করে তত্বাবধায়ক সরকার গঠন হয় আমি বুঝে পাই না । তবে ছোট বেলা থেকেই তো জেনেছি, ‘জোর যার মুলুক তার!’ তা বোধহয় আবার প্রমাণ হল। তাও শেখ হাসিনারই সব দোষ, উনি নাকি “স্বৈরাচারী”। আচ্ছা… বলুন তো এখন যেটা হচ্ছে…. অবাধ লুটতরাজ, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ…. সেটাকে কী বলব? সোনার বাংলাদেশ তৈরীর প্রথম ধাপ বুঝি? তার জন্যই অসংখ্য মানুষ নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে শরণার্থী হয়ে প্রতিবেশী দেশে যাওয়ার জন্য কাঁটাতারের সামনে হত্যে দিয়ে বসে থাকে? সংখ্যালঘুদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর মিছিল করে রাস্তায় নামতে হয় নিজের দেশেই সুরক্ষার জন্য?
একটা শিশুও তো বুঝবে কীভাবে ছাত্র হত্যা, সাধারণ মানুষকে হত্যা করে ছাত্র ও সাধারণ মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা দখলের খেলা চলছে। শুধু আমরা বড়রাই বুঝতে চাইছি না, তাই না?
আচ্ছা, বলুন তো, হাসিনা যদি আমেরিকাকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ দিয়ে দিতেন তাহলে শেখ হাসিনাও শান্তির জন্য নোবল পুরস্কার পেতেন কি? কারণ আমেরিকা এখনও পৃথিবীর সব চাইতে ক্ষমতাবান দেশ। আর ডঃ ইউনুস আমেরিকার কৃপাদৃষ্টি পাওয়া সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি যিনি কিনা এত ছাত্র এবং সাধারণ মানুষের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে শপথ নিয়েছেন কিছুদিন আগেই। এখন সত্যিই প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ক্ষমতা নিয়ে ঠিক কীভাবে সাম্যের বাংলাদেশ গঠন করবেন? একজন মাইক্রো ক্রেডিটের অধ্যাপক যিনি নাকি শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন আর যাঁর জন্য বাংলাদেশের অনেক মহিলা এবং গ্রামের মানুষ ঋণ শোধ করতে না পারার কষ্টে এবং হতাশায় আত্মহত্যা করেছেন, তিনি কি সত্যিই এই শঙ্কটকালে দেশকে নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতম মানুষ?
আমি আবার বলছি, আমার প্রচুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বা কূটনৈতিক পান্ডিত্য নেই। কিন্ত আমার সাধারণ বুদ্ধিতে আজ এতটুকু বুঝতে পারছি আমেরিকা কত স্মার্ট, ধূর্ত এবং ধৈর্যশীল। ১৯৭১ সালে যা পারেনি তা পেরেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর !
ছোটবেলায় পরা রূপকথার গল্পের মত “ডেভিল” কে “অ্যাঞ্জেল” আর “অ্যাঞ্জেল”কে ডেভিল বানাতে পারে এই সর্বশক্তিমান দেশ, আমার বর্তমান বাসস্থান। ডঃ ইউনুস ও শেখ হাসিনা তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
লেখাটা শেষ করার আগে আমার শেষ প্রশ্নটা রেখে যাই আপনাদের কাছে:
ডঃ ইউনুসের কি শপথ নেওয়ার সময় কিছুক্ষণের জন্য বিবেক জেগে উঠেছিল? কারণ উনি শপথের সময় তোতলাচ্ছিলেন, পুরো বিশ্ব তা দেখেছে।