শেখ হাসিনা নিজের কবর নিজেই খুঁড়েছেন

শেখ হাসিনা নিজের কবর নিজেই খুঁড়েছেন
Spread the love

ঢাকা থেকে লিখেছেন সাংবাদিক রেজওয়ান সিদ্দিকী

মার্কিন রাজনীতিবিদ থমাস জেফারসনের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখাটি শুরু করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, যখন জনগণ সরকারকে ভয় পায়, তখন স্বৈরাচার। যখন সরকার জনগণকে ভয় পায়, তখন স্বাধীনতা।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে জেফারসনের কথাটি খুবই প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে, শেখ হাসিনা সরকার টানা ১৫ বছর ৬ মাস ক্ষমতায় ছিল। এই সময়টায় বিএনপিসহ তার প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো রাজনৈতিক দলকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেননি। যেকোনো পরিস্থিতি সফলতার সাথে সামলেছেন। এতে করে তিনি সাধারণ মানুষের প্রতি ভীতির সঞ্চার করতে পেরেছেন।

ফলে দেখা যায়, হাসিনা সরকারকে ভালবাসার বদলে ভয় পেয়ে এসেছেন জনগণ। গণতন্ত্রের বুলি আওড়ে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেরে যখন মুজিবকন্যাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করানো হলো, তখন আমজনতার বড় একটি অংশ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন স্বাধীনতা উদযাপনে। তাঁদের মতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর এটাই দ্বিতীয় স্বাধীনতা। এমনকি ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারী হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার গণঅভ্যুথানও চাপা পড়ে গেছে এর সাফল্যের নীচে।

৫ আগস্ট যখন হাসিনার দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ল ছাত্র-জনতার মধ্যে তখন অধিকাংশ মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। বিজয়োল্লাস করেন। তারা যেভাবে তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করছিলেন, তা নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন। এত বছর ধরে জমানো ক্ষোভ বারুদের মতো বেরিয়ে এসেছে।

খোলা চোখে দেখলে শাসনামলে শেখ হাসিনা উল্লেখ করার মতো উন্নয়ন করেছেন বলা যায়। প্রমত্তা পদ্মার বুকে সেতু নির্মাণ তাঁর একটি বড় কাজ। এছাড়া চট্টগ্রামে কর্ণফুলি টানেল। দেশকে ডিজিটাল নেটওয়ার্কের মধ্যে আনা। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ। মাথাপিছু আয়ে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাওয়া। শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জ্বালানি ও অবকাঠামো উন্নয়নেও ভূমিকা রাখেন।

এখন প্রশ্ন হলো— চোখে পড়ার মতো এমন উন্নয়নের পরেই শেখ হাসিনা কেন মানুষের মনে ঠাঁই পাননি? কেন তাঁকে সব রেখে গোপনে দেশ ছাড়তে হলো?

ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য হাসিনা মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছেন। এমনও দেখা গেছে তাঁর দলীয় লোকেরা (বিশেষ করে অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ) নৌকায় ‘সিল মেরে’ ব্যালেট বাক্স ভরেছেন। ভোটকেন্দ্র থেকে ভোটার ফিরেও গেছেন। এমনকি মৃত মানুষও ভোট দেওয়ার নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে!

বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে বারবার নির্লজ্জের মতো বিভিন্ন বক্তৃতায় বলেছেন, তাঁর ক্ষমতার মোহ নেই। জোর করে নয়, বরং জনগণ তাঁকে দেশের সেবার করার দায়িত্ব দিয়েছেন। এটাও গর্বের সঙ্গে বলেছেন, তিনি মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছেন!

এই ১৫ বছরের শাসনকালে হাসিনা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। পুরো সময়টায় খুন-গুম চলেছে পাল্লা দিয়ে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনা বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম। একযুগ পেরিয়ে গেলেও তিনি এখনও ফিরে আসেননি।

২০০৯ সালে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। শেখ হাসিনা এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করেছেন ঠিকই। কিন্তু এই ঘটনার পেছনে কার হাত রয়েছে— সেই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়নি। এমনকি সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে তাঁর সরকার কখনও আন্তরিকতা দেখায়নি। ফলে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ১০৫ বার পিছিয়েছে।

হাসিনার আমলে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে লাগামছাড়া। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট বলয় তাঁর বাণিজ্যমন্ত্রীরা কখনও ভাঙতে পারেননি। তাঁকেও কখনও শক্ত অবস্থানে যেতে দেখা যায়নি। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস উঠে যায়। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় হাসিনা কখন জনগণের কাছে কখনও জবাবদিহি করেননি। দু’টি আশার কথাও শোনাননি। এমন সব কথা বলেছেন যা তাকে স্বৈরাচারী হিসেবে প্রমাণ করতে যথেষ্ট ছিল। এই যেমন পেঁয়াজের দাম যখন বাড়ল, তখন পেঁয়াজ ছাড়া রান্না করতে বললেন। তারপর যখন বেগুনের দাম বাড়ল, তখন এর বদলে মিষ্টি কুমড়া দিয়ে বেগুনি ভাজতে পরামর্শ দিলেন। সবশেষ যখন গোমাংসের মূল্য সাধারণের ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেল, তখন কাঁঠাল খেতে বললেন। একজন প্রধানমন্ত্রী কাছ থেকে জনগণ এ ধরনের কথা কখনও আশা করেন না। তাঁরা চান তিনি এমন কথা বলুন, যা শুনে আশ্বস্ত হওয়া যায়। ভরসা পাওয়া যায়।

লুণ্ঠনের রাজনীতি হয়েছে অবিশ্বাস্য। হাসিনার মন্ত্রী-এমপি, সরকারি কর্মচারি এমনকি পিয়ন থেকে ড্রাইভার যেভাবে দুর্নীতি করেছেন, তা ছিল নজিরবিহীন। যার কারণে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন হাসিনা। রাজাকারদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর এবং ইসলামি সংগঠনের বিভিন্ন নেতাদের কারাদণ্ড দিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষের চক্ষুশূল হয়েছিলেন হাসিনা। এটা তাঁর পতনের অন্যতম বড় কারণ।  

তবে দেশের মানুষ শেখ হাসিনার প্রতি বেশি ক্ষুব্ধ ভারতপ্রীতির জন্য। যখনই রাষ্ট্রীয় সফরে প্রতিবেশী দেশটি গেছেন, তখনই বলা হয়— তিনি দেশ বিক্রি করে এসেছেন। কারণ, দু-দেশের মধ্যে এমন সব চুক্তি সম্পাদন করা হয়, সেখানে ভারত সুবিধা পায় বেশি। সবশেষ চলতি বছরে দিল্লি সফরে ‘রেল ট্রানজিট’ চুক্তি নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারতের ট্রেন চলবে, এটা মেনে নেবেন না জনতা। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, এর মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হবে। তবে সেসবে তোয়াক্কা না করে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন শেখ হাসিনা।

টানা ক্ষমতায় থাকায় শেখ হাসিনা অতি-আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। স্বৈরাচারী শাসকের মতো নিজের সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত মনে করতেন। ভালো-মন্দ দিক বিবেচনা করতেন না। ফলে এমন সব কথা তাঁর মুখ থেকে বের হতো, যা জনগণের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার করত। এ কারণেই কোটাবিরোধী (মুক্তিযোদ্ধা) আন্দোলনে এই শাসক নিজের কবর নিজে খুঁড়ে ফেলেন।কোটাবিরোধী আন্দোলন প্রথম শুরু হয় ২০১৮ সালে। সেবার তিনি ছাত্রদের কথা মেনে সামলে নেন। তেমন একটা ঝামেলার মুখে পড়তে হয়নি। ওই সময় কোটা বাতিলের যে নির্বাহী পরিপত্র জারি করা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা হাইকোর্টে একটি রিট করেন। হাইকোর্ট ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর এই কোটা পরিবর্তনের পরিপত্রটিকে বাতিল করে দেন। ফলে কোটা পুনর্বহাল হয়।

জুলাই মাসে যখন দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করে ছাত্ররা, তখন তাচ্ছিল্য করেন শেখ হাসিনা। ১৪ জুলাই চীন সফর নিয়ে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আন্দোলনকারীরা দাবি করছেন মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিরা কোটা সুবিধা পেতে পারবেন না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে-তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা পাবে? তা তো আমরা দিতে পারি না।

এই একটি কথাই ‘কাল’ হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। ক্ষোভ বেড়ে যায় শিক্ষার্থীদের মাঝে। তাঁরা স্লোগান দেন: ‘এই বল, তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!’ ক্রমেই বাড়তে থাকে আন্দোলন। উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে বলপ্রয়োগ করেন হাসিনা। বন্ধ করে দেন ইন্টারনেট পরিষেবা। জারি করা হয় কারফিউ। নির্বাহী আদেশে দেওয়া হয় সরকারি ছুটি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগকে নামিয়ে দেওয়া হয় রাস্তায়। শতাধিক শিক্ষার্থী নিহত ও মারাত্মকভাবে আহত হন। বিশ্ব মিডিয়া ফলাও করে প্রকাশ করে সেই খবর। যদিও এর মধ্যে আপিল বিভাগে শুনানিতে শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ হয়। কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের রায় দেয়া হয়।

কারফিউ দিয়ে পরিস্থিতি খানিকটা সামলে নেন হাসিনা। পরে নিরাপত্তা দেওয়ার নামে ছয় সমন্বয়ককে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কার্যালয়ে নিয়ে আন্দোলন তুলে নেওয়ার লিখিত বক্তব্য পাঠ করানো হয়। পরে তাঁরা ছাড়া পেয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা করে দেন। তখনই পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে চলে যায়।

এমন টালমাটাল অবস্থায় সুর নরম করেন শেখ হাসিনা। জানান, আলোচনার জন্য গণভবনের দরজা খোলা আছে। কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। কয়েকদিন আগেই বড় মুখ নিয়ে বলেছিলেন, শেখ হাসিনা পালায় না। অথচ তিনি পালিয়ে গেলেন দেশ থেকে। স্বৈরাচারী এরশাদের চেয়েও করুণ পরিণতি হলো তার। এরশাদ গদি থেকে নামলেও দেশ ছাড়েননি। কিন্তু তিনি…!

হাসিনা সবসময় স্বজন হারানোর ব্যথা কী, তা বুঝি— বলে সহানুভূতি আদায় করতেন। কথায় কথায় বিএনপি-জামাত আর জঙ্গিকে পুঁজি করে প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রেখেছেন। শেষ মুহূর্তে ছাত্র আন্দোলনে বিএনপি-জামাত-জঙ্গি সদস্যরা ঢুকে পড়েছেন বলেও জনসমর্থন পাননি। তবে এটা ঠিক যে, কেবলমাত্র ছাত্র আন্দোলনের কাছে পরাজিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে পালাননি শেখ হাসিনা। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভূ-রাজনীতি। চোখ-কান খোলা রাখলেই তাদের কলকাঠি নাড়া দেশগুলোর নাম খুঁজে পাওয়া যাবে।

শিগগিরই গঠিত হবে অন্তবর্তীকালীন সরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এ ছাড়া এই তালিকায় আরও অনেকের নাম আছে। শিগগিরই তা চূড়ান্ত হবে। এই সরকার তিন মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করবে। সেই নির্বাচনে জনগণ ভোটের অধিকার ফিরে পাবেন এবং দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, এটাই এখন লাল-সবুজের দেশটির সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।


Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *