এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার!

এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার!
Spread the love

পুলকেশ ঘোষ

কয়েক লক্ষ মানুষ ঢুকে পড়ল গণভবনে। ঠিক তার আগেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ দেশ ছেড়ে পালালেন। বাংলাদেশের মানুষ এই ‘স্বৈরাচারী’ শাসকের পতনে মুক্তির আনন্দে হইহই করে রাস্তায় নেমে পড়লেন।

এটা সোমবার সকালের ছবি। এই ছবি আরও অনেক গণ অভ্যুত্থানেও দেখা গিয়েছে। কিন্তু বিকেল থেকে ছবিটা আর আমজনতার রইল না। সামাজিক মাধ্যম জুড়ে শুধুই কান্নার লাইভ। ঘরবাড়ি ভাঙচুর, আগুন, মারধর। অগেই অনেকে শাসকের পতনকে ‘নয়া মুক্তিযুদ্ধ’ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এ কোন মুক্তিযুদ্ধ? শাসকের অত্যাচার থেকে মুক্তির পর মৌলবাদীদের চরম নৃশংসতা। কী আখ্যা দেওয়া যাবে একে? দাঙ্গা? নাকি প্রতিশোধ? প্রতিশোধ কার ওপর? কীসের?

যে কোনও সভ্য জাতির লক্ষণ তার ইতিহাস সচেতনতা। বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তার মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে। স্বাধীনতার অর্ধশতবর্ষে সেই ইতিহাসকে ধূলিসাৎ করে এ কোন ইতিহাস তৈরি করছেন আন্দোলনকারীরা? যদি হাসিনার শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয় তাহলে কি তাঁর পিতা তথা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করা জরুরি? তাঁর মূর্তি ভেঙে কি তাঁর অবদানকে মুছে যাবে? দেশের জন্য প্রাণ দিতে রাজি থাকা আর একটা বঙ্গবন্ধু তৈরি করা যাবে? যিনি দেশের মানুষের ওপর অত্যাচার করবেন না। যিনি সবার বন্ধু হবেন, আস্থা অর্জন করবেন।

বারবার মনে প্রশ্ন জাগছে, এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার!

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশে এক অসাধারণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এটা আদৌ বলা যাবে না। তবে একইসঙ্গে দেশের উন্নয়নে তাঁর বড় ভূমিকাও অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তাঁর সমস্যা অন্য জায়গায়। সব দেশেই শাসকের চরিত্র একই হয়। তাঁরা ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার পর গদির জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে রাজি থাকেন। মায়া-মমতা, নীতি-আদর্শ আর তাঁদের কাছে খুব একটা জরুরি বলে মনে হয় না। তাঁরা নিজেদের অপরিহার্য বলে ভাবেন। যেমন আমরা ভাবি আমি না বেঁচে থাকলে সংসারটা ভেসে যাবে। দীর্ঘ জীবনে খুব কম সংসারকেই ভেসে যেতে দেখেছি। তবু ওটাই আমরা বিশ্বাস করতে ভালবাসি। নন্দলালের মতো সব শাসকের ধারণা থাকে, তিনি না থাকলে অভাগা দেশের হইবে কী! হাসিনাও এর বাইরে নন। তিনিও অন্য শাসকদের মতো স্তাবকতা পছন্দ করতেন। স্তাবকরাও তাই তাঁকে ঘিরে থাকতেন। সত্যি জানতে দেওয়ার বদলে তাঁকে খুশি করাই স্তাবকদের কাজ ছিল। এভাবে নিচুতলায় সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে শাসকদলের ছাত্রনেতারাও তাঁর ছত্রছায়ায় থেকে কী তাণ্ডব চালাচ্ছে তা তিনি জানতেন না। তাঁকে জানতে দেওয়াই হত না। তাঁর দলের নেতারা গুণ্ডা পুষেই ব্যবসা চালাতেন। ছাত্রনেতাদের গুণ্ডামির লাইসেন্স দিতেন। তারজন্য বাংলাদেশের মানুষকে অনেক অত্যাচার সইতে হয়েছে। কিন্তু ভয়ে কেউ বলতে সাহস করেননি। কিন্তু জমিয়ে রাখা ক্ষোভের লক্ষ্য হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

এই জমিয়ে থাকা ক্ষোভেই ঘৃতাহুতি দিয়েছিল ছাত্রদের কোটা আন্দোলন। কিন্তু কোটা আন্দোলন শেষ হওয়ার আগেই ধীরে ধীরে ছাত্ররা নেতৃত্ব থেকে সরে গিয়ে আরও নানা মুখ আন্দোলনের হাল ধরে তার অভিমুখ ঘুরিয়ে দেন। ছাত্রদের সমর্থনে দেশের মানুষ যখন শাসকের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস জোগাড় করে ফেলেছেন, তখন সেই তৈরি মাটিতে প্রধানমন্ত্রীকে গদিছাড়া করার দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। এই পর্বের আন্দোলন পুরোপুরি রাজনৈতিক। যাঁরা নীতির কারণে ভোটে লড়া থেকে বিরত থেকেছেন তাঁরাই অন্য পথে ৮ মাস আগে গদিতে বসা শাসকের বিরুদ্ধে কৌশলী লড়াইয়ে নামলেন। এবং একটা সুপরিকল্পিত আন্দোলন সাফল্য পেল।

এতেও কোনও অসুবিধা ছিল না। কিন্তু এতদিন যাঁরা সাফল্যের সঙ্গে আসল পরিচয়টা গুপ্ত রাখতে পেরেছিলেন, হাসিনা দেশ ছাড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা নিজেদের পরিচয় জাহির করল। সারা পৃথিবী অন্য ছবি দেখল। দেখল বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই কীভাবে বৈষম্য ডেকে আনল। এই পরিবর্তনও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ভালভাবে নেয়নি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি করে বাস করা মানুষজন আচমকা পর হয়ে গেলে ধাক্কা লাগবেই। কারও দোকানে আগুন ধরানো, খুন-খারাপি, মারধর, বাড়ি ভাঙচুর করে তছনছ করে দেওয়া কোনও সভ্য মানুষের কাজ হতে পারে না। যে বাঙালি ভাষার জন্য আন্দোলন করে বিশ্বের ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের জন্ম দিয়েছে, সেই বাঙালি জাতের নামে বজ্জাতি করে না। সেই দেশের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের নয়া প্রজন্ম এই বিচ্যুত নেতাদের চিহ্নিত করে সরিয়ে দেবে বলেই আমার বিশ্বাস। কারণ, বাঙালিই পারে গাইতে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’।


Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *