বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতার ক্ষতি অর্থনীতিতে বিরাট ধাক্কা

বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতার ক্ষতি অর্থনীতিতে বিরাট ধাক্কা
Spread the love

প্রফেসর ডঃ মিজানুর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ

বিগত কয়েকদিনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এক উত্তাল সময় পার করলো বাংলাদেশ। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবীতে শুরু হওয়া ছাত্রদের এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় মারাত্মক সহিংসতায়। ব্যাপক প্রাণহানি, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়া থেকে শুরু করে বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত সম্পদ ধ্বংস হওয়ার মতো যত ধরনের ক্ষতি হওয়া সম্ভব তার সবই গত কয়েকদিনে হয়েছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে। ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ এক আন্দোলন কী করে এমন সহিংসতায় রূপ নিলো তা নিয়ে বিস্ময়ের শেষ নেই। তবে বিগত কয়েকদিনের এই সহিংসতার প্রভাব যে বাংলাদেশকে দীর্ঘ মেয়াদে বয়ে বেড়াতে হবে তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই এবং এ নিয়ে বিস্তর বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন রয়েছে। 

প্রথমত, কোটা আন্দোলনের সহিংসতার ফলে যে প্রাণহানি ঘটেছে তা মর্মান্তিক এবং এ ক্ষতি অপূরণীয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ১৫০ জন নিহত হয়েছেন, তবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলছে নিহতের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়েছে। আহত হয়েছেন ১০০০ জনের বেশি। আহতদের অনেকেই হয়তো আর কখনোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না। আলোচনার মাধ্যমে সমাধানযোগ্য এই বিষয়টির জন্য শেষ পর্যন্ত চড়া মূল্য দিতে হলো। নিহতদের মধ্যে শিক্ষার্থী, পুলিশ, সাংবাদিক, পথচারী, খেটে খাওয়া মানুষ এমনকি ঘরের বারান্দায় খেলাধূলায় ব্যস্ত শিশুও ছিল যাদের অনেকেরই এই আন্দোলনের সাথে কোনো সম্পৃক্ততাই ছিল না। সব পক্ষ সংযত আচরণ করলে হয়তো এই প্রাণহানি এড়ানো যেত। যার গেছে সেই হারানোর বেদনা বোঝে। নিহতদের পরিবারগুলো কি কখনোই এই শোক এবং ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে?  

দ্বিতীয়ত, সহিংসতার ফলে ব্যাপক সম্পদ ধ্বংস ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকারি ও বেসরকারি পরিবহন খাতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার উপরে। নাশকতাকারিরা মিরপুর ১০ ও কাজীপাড়া মেট্রোস্টেশনে ভাঙচুর চালিয়েছে যা মেরামতে এক বছর লাগতে পারে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ২৯টি গাড়ি ভস্মীভূত ও আরও কয়েকটি যানবাহন ভাংচুর করা হয়েছে যাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২১৫ কোটি টাকার। বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট স্থাপনায় হামলায় ক্ষতির পরিমাণ ১০০০ কোটি টাকার ওপরে। তাছাড়া দেশজুড়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় নাশকতায় কয়েক হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। জনগণের টাকায় গড়া এসব স্থাপনার মেরামতের ব্যয়ের ভার জনগণকেই নিতে হবে।

তৃতীয়ত, কোটা আন্দোলনকে ঘিরে যে সহিংসতা হয়েছে দেশের অর্থনীতিকে দীর্ঘ মেয়াদে এই ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে। সহিংসতা চলাকালীন সময়ে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা কার্যত অচল হয়ে পড়ে, যার প্রভাব পড়ে বাজারে। মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ সংকটসহ বিভিন্ন কারণে দেশের অর্থনীতি এমনিতেই কঠিন সময় পার করছে, তারমধ্যে কোটা আন্দোলনের সহিংসতা মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, গত কয়েকদিনে প্রতিদিন প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সফটওয়্যার রপ্তানিতে ৫ দিনে ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, তৈরি পোশাক শিল্পে দৈনিক ১৬০০ কোটি টাকা লোকসান এবং ফ্রিল্যান্সারদের ক্ষতি হয়েছে ২৯০ কোটি টাকার ওপরে। অর্থনীতিবিদরা আশংকা করেছেন, এই সংকটের নেতিবাচক প্রভাব মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতেও পড়তে পারে।

চতুর্থত, গত কিছুদিনের ঘটনায় আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সহিংসতার খবর যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তা বাংলাদেশের জন্য ভালো হয়নি। তবে তাদের প্রতিবেদনে আন্দোলনের সহিংসতা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা কারা করলো, কীভাবে ঘটলো সে বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়নি। সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভ করতে গিয়ে ৫৭ জন বাংলাদেশির বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয় যাদের মধ্যে ৩ জনকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। মালদ্বীপ একই ইস্যুতে বিক্ষোভে জড়িত বাংলাদেশিদের দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব ঘটনায় বিদেশে শ্রম বাজারে প্রভাব পড়লে তা অর্থনীতির জন্য বিরাট ধাক্কা হবে। ব্যবসায়ীদের আশংকা, সাম্প্রতিক ঘটনাবলির কারণে বিদেশিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ হারালে দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘ মেয়াদে বড় সংকট তৈরি হবে।

সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহিংসতা যে ক্ষতি বয়ে এনেছে তা দেশের প্রতিটি মানুষকে দীর্ঘমেয়াদে প্রভাবিত করবে। মানবসম্পদ, অর্থনীতি, এবং দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ক্ষতির প্রভাব ভবিষ্যতে আরও গভীর হতে পারে, বিশেষত বিদেশি বিনিয়োগ ও শ্রম বাজারের ক্ষেত্রে। এই আন্দোলন আমাদের শিখিয়ে গেলো যে সংযম এবং শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কোনো বিকল্প নেই। দেশের উন্নয়নের জন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।


Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *