বাঙালের পান্তাভাত

বাঙালের পান্তাভাত
Spread the love

রন্তিদেব সেনগুপ্ত

আমার সেজোকাকা কখনো পান্তাভাত বলতে পারত না। পান্তাকে পান্তো বলত। সে নিয়ে বাড়িতে হাসিঠাট্টা কিছু কম হত না। কিন্তু সেজোকাকাকে পান্তা কেউ কোনোদিন বলাতে পারেনি। যতদিন বেঁচে ছিল , পান্তাকে পান্তোই বলে গেছে। এ নিয়ে বেশি হাসিঠাট্টা হলে সেজোকাকার নির্বিকার উত্তর ছিল — ” আমি যদি পান্তো কই,তাইলে তগো ক্ষতি কী। তরা বুঝতে পারলেই ত হইল। ” তা সে পান্তা হোক কি পান্তো , পয়লা বৈশাখ পেরলে যেই গরমটা জমিয়ে পড়তে শুরু করত , অমনি আমার সেজোকাকার পান্তো খাওয়া শুরু হয়ে যেত। হাঁড়িতে জল দিয়ে ঠান্ডা করে পান্তা বানিয়ে রাখত আমার ঠাকুমা। সঙ্গে ডালের বড়া বা পেঁয়াজি । আর কাঁচা লঙ্কা আর পেঁয়াজ কুঁচি।  গন্ধরাজ লেবু  দিয়ে সেই ভাত মেখে হাপুস হুপুস করে খেত সেজোকাকা। খাওয়া হয়ে গেলে একটি তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলত  — ” মা , বোঝলা,  শরীরডা জুড়াইয়া গেল। ” পুত্রের শরীর জুড়িয়ে গেছে শুনে আমার ঠাকুমাও যারপরনাই তৃপ্তি পেতেন। বৈশাখ  – জ্যৈষ্ঠ এই দুমাস ধরে পাঁঠার মাংসের মতো লোভনীয় খাদ্যও অক্লেশে ত্যাগ করতেন আমার সেজোকাকা পান্তো খাওয়ার  আকর্ষণে।

অবশ্য শুধু সেজোকাকা কেন , গরম পড়লে পান্তা ভাত খাওয়ার একটা প্রচলন আমাদের বাঙাল বাড়িতে ছিল। গরমটা একটু জেঁকে পড়লেই দুপুরে পান্তা খাওয়া শুরু হয়ে যেত। ডালের বড়া ,পেঁয়াজি এসব তো ছিলই,  সেই সঙ্গে কোনও কোনও  দিন কুচো মাছ ভাজাও হত । আমাদের বাঁধাধরা এক তরকারিওলাও ছিল। একদিন অন্তর একদিন সে ঝাঁকা ভরতি তরকারি নিয়ে এসে হাজির হত।  ঠাকুমা নিজে ঝাঁকা থেকে বেছে বেছে তরকারি তুলত। সে বেশ ডাগর ডোগর গন্ধরাজ লেবু নিয়ে আসত। পান্তাভাতে সেই গন্ধরাজ লেবু মেখে খেতে হত। সে লেবুর বেশ সুবাস ছড়িয়ে পড়ত। ঠাকুমা বলত –” এই গন্ধেই তো প্যাট ভইরা যায়।” এরপর অবশ্যম্ভাবীভাবে ঠাকুমার বাপের বাড়ি পুব বাংলার নারাণগঞ্জে বাড়ির পিছনে গন্ধরাজ লেবুর গাছে কেমন সম্বৎসর থোকা থোকা লেবু ফলে থাকত , সে গল্প পান্তা খেতে খেতে ঠাকুমার মুখে শুনতে হত আমাদের। এই গল্প শোনাতে শোনাতে শেষ দিকে ঠাকুমার গলা ধরে আসত।

রঞ্জুকাকুর পছন্দ ছিল পান্তাভাতের সঙ্গে বেগুন পোড়া। তবে সব বেগুন পোড়ালে নাকি স্বাদ হয় না। বলত ঠাকুমা। বেগুন পোড়া খাওয়ার জন্য বেগুন হতে হবে বেশ নধর হৃষ্টপুষ্ট একটু লম্বাটে গোছের। উনুনের আগুনে পোড়াতে দিলেই তার গন্ধে বাড়ি মাত হয়ে যাবে তবেই না বেগুন। কাজেই , তরকারিওলার ঝুড়ি থেকে  পোড়ানোর জন্য বেগুন আমার ঠাকুমা স্বহস্তে বেছে নিত।

তবে , বেগুন পোড়া যে শুধু পান্তা ভাতেই খাওয়া হত এমনও নয়। আমাদের বাঙাল বাড়িতে বেগুন পোড়া ছিল খুব লোভনীয় খাদ্য। শীতকালে খুব যত্ন করে বেগুন পোড়াতো ঠাকুমা। ঘানি থেকে আনা ঝাঁঝালো সরষের তেল , পেঁয়াজ কুঁচি লঙ্কা কুঁচি  আর লাল লাল টমেটো দিয়ে বেগুন পোড়া মাখা হত। জলখাবারে গরম গরম আটারুটি দিয়ে সে বেগুন পোড়া খেতাম আমরা। কোনো কোনো দিন রাতের খাবারেও বেগুন পোড়া আর রুটি। রুটি খাওয়ারও আবার তরিবত ছিল। একটি একটি করে গরম রুটি সেঁকে পাতে দেওয়া হত। সেটাও ঠাকুমার নিদান। বলত –” রুটি ঠান্ডা হইলে খাওন যায় নাকি।”

টমেটোর কথা যখন উঠল তখন বলি। কাঁচা টমেটো ছোট ছোট করে কেটে সরষে বাটা দিয়ে একটা চাটনি মতো করত ঠাকুমা। আহা , কী স্বর্গীয় স্বাদ ছিল তার। অমনটি আর খেলাম না তার পরে।

আমার এদেশি বন্ধুরা বলত, এখনো বলে, বাঙালরা বেশি ভাত খায়। ভুল কিছু বলে না। ভাতের প্রতি আমাদের , বাঙালদের,  পক্ষপাতিত্ব একটু বেশি। ফলে গরমের পান্তাভাত যে শুধু দুপুরেই খেতাম আমরা তা নয়। অনেকদিনই সকালে জলখাবারেও গন্ধলেবু দিয়ে মেখে ডালের বড়া সহযোগে পান্তা ভাত খাওয়ার চল ছিল আমাদের বাঙাল বাড়িতেও।

শুধু পান্তা ভাত নয় , অন্য সময়েও দিনে তিন বেলা ভাত না হলে চলত না আমাদের। দুপুরে রাতে খাওয়ার পাতে ভাত তো ছিলই।  সকালের জলখাবারেও কোনও কোনোদিন গরম ভাত আলুসিদ্ধ ডিমসিদ্ধ সঙ্গে ঘি কাঁচালঙ্কা বেশ রসিয়ে খাওয়া হত। আমার মনে আছে, আমার মাসতুতো দাদার বিয়েতে ত্রিপুরা গিয়েছিলাম। সেখানে রোজ সকালে ঘুম ভাঙার পরে সকলকে জনে জনে জিজ্ঞাসা করা হত — ” আজ কী খাইবা ? বাটার ভাত ,না শুঁটকি ভাত ?” বাটার ভাত অর্থে গরম ভাতের সঙ্গে ঘি আলুসিদ্ধ ডিমসিদ্ধ। আর শুঁটকি ভাত অর্থে সিঁদল শুঁটকি বাটা আর গরম ভাত। আমি অবশ্যই  শুঁটকি ভাতটাই বেছে নিতাম। আমাদের বাঙাল বাড়িতে শুঁটকি ছিল বড় আদরের বস্তু। এই তো সেদিন আমার বাংলাদেশের এক বন্ধু জানালো এ মাসের শেষে সে কলকাতা আসছে। জিজ্ঞাসা করেছিল -” তোমার লেইগ্যা কী আনুম দোস্ত ?” নির্দ্বিধায় তাকে বলে দিলাম , লইট্যা শুঁটকি। শুঁটকি নিয়ে এখন বলতে বসলে সে আরব্য রজনীর উপাখ্যান হয়ে দাঁড়াবে। বাঙালবাড়ির শুঁটকি বিলাস নিয়ে পরে একদিন বলা যাবে।

আমাদের বাঙালবাড়ির সেই যৌথ পরিবার এখন ছত্রখান হয়ে গেছে। এখন বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে সবাই। আমার ঠাকুমা আমার সেজোকাকা আমার রঞ্জুকাকু সবাই এখন ঘরের দেওয়ালে ফ্রেমবন্দি। তবু এই ঝাঁ ঝাঁ গরমের দুপুরে জল ঢালা পান্তাভাতে যখন গন্ধলেবু চটকে নিই  তখন তারা আমার চারপাশে ঘিরে দাঁড়ায়।  স্নেহাতুর  কন্ঠে বলে ,” পান্তা খাইলে শরীরডা ঠান্ডা থাকে ।”


Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *