হীরামন্ডী

হীরামন্ডী
Spread the love

শবরী চক্রবর্তী

ইতিহাসের মলাট, জমকালো সেট, ঝকমকে পোশাক, চারদিকে বড়ো  বাজেটের সুগন্ধ, আর সবকিছু ছাপিয়ে নিরন্তর প্রেম—সঞ্জয় লীলা বনশালির সংজ্ঞা এটাই। এতদিন  দর্শক তাঁর ইন্দ্রজাল দেখেছে বড়ো পর্দায়, এবার তিনি পা রেখেছেন  এখনকার ওটিটি-তে।  নিয়ে  এসেছেন ‘হীরামণ্ডী, দ্য ডায়মন্ড বাজার’।  ১ মে, ২০২৪-এ নেটফ্লিক্সে স্ট্রিমিং হল। ভারতীয় বিনোদনের নতুন  মঞ্চে  আবির্ভূত হয়ে  নিজস্বতাতেই  আপাদমস্তক মুড়ে ওয়েব সিরিজের  চেহারা এবং তার সম্বন্ধে  ধ্যানধারণা একেবারে পালটে দিয়েছেন, এতটা বলা না গেলেও মানুষকে যে থমকে দিয়েছেন তাঁর হিরে বাজারের জৌলুস দিয়ে, তা বলা যায়।

১৪ বছর আগে এই গল্প শুনেছিলেন , তখন বনশালি  ‘দেবদাস’ করছেন। মইন বেগ নামে একজন তাঁকে  এই গল্প বলেছিলেন। তখন থেকেই এই হীরামণ্ডী তাঁর মনে গেঁথে  আছে। প্রথমে সিরিজের প্রধান চরিত্রে রেখাকে মল্লিকাজান হিসেবে ভেবেছিলেন, অন্য দুটি চরিত্রে করিনা কপুর ও রানি মুখোপাধ্যায়। সেই ভাবনা আর এগোয়নি। তারপর শুধু ছবিই করেছেন।  এতদিনে তিনি সেই অবসর পেয়েছেন ওটিটিতে নতুন কিছু করে দেখানোর, অবশ্যই নিজের সিগনেচার টিউনে। সুতরাং বেছে নিলেন সেই হীরামণ্ডীঃ দ্য ডায়মন্ড বাজার-কেই।

গল্পটাও আকর্ষণীয়। পাকিস্তানের লাহোরে  হীরামণ্ডী  বলে একটি জায়গা আছে।  নামের উৎস রাজা হীরা সিং, তিনি একটি শস্যের বাজার চালু করেছিলেন, নাম হীরা দি মণ্ডী। সেই মুঘল আমল থেকে এই জায়গার খ্যাতি।  পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান থেকে মেয়েরা এখানে আসত কত্থক শিখতে, উদ্দেশ্য মুঘল নবাবদের বিনোদন।  ১৭৪৮-এ আহমদ শাহ দুরানির ভারত আক্রমণের পরই পরিস্থিতি বদলে যায়।  তখন থেকেই বন্দিনী মেয়েদের গণিকা করে এই হীরামণ্ডীতে আনা শুরু হল।  ধীরে ধীরে এটি গণিকালয়ে পরিণত হয়। ১৭৯৯-এ মহারাজা রণজিৎ সিং লাহোর ধ্বংস করার সময়েও এটি গণিকালয়ই ছিল। ইংরেজ আমলে তার শ্রীবৃদ্ধি হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার এটি বন্ধ করতে চেষ্টা করে, সৌজন্য প্রেসিডেন্ট  জিয়া উল হক, সাল ১৯৭৮-১৯৮৮। কিন্তু কাজটা হয়নি। এখনও সে দেশে এই হীরামন্ডী আছে। এখন মেয়েরা মোবাইলে অ্যাপ ব্যবহার করে এসকর্ট সার্ভিস হিসেবে কাজ করে।

কিন্তু  ব্রিটিশ যুগে  এই হীরামণ্ডীর একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ইংরেজ  শাসনের হাত থেকে  দেশকে বাঁচাতে যখন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা রক্ত ঝরাচ্ছে, এই মণ্ডী তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল।  আবার  মণ্ডীর ভিতরেও একটা যুদ্ধ ততদিনে শুরু হয়েছে। বনশালির হীরামণ্ডী-র প্রেক্ষাপট এটাই।

হীরামণ্ডী-র  শাহি মহলের প্রধান মল্লিকাজান। মল্লিকাজান মানে ভয়ঙ্কর ক্রুর এক মহিলা। তার নিজের দুই মেয়ে সেই মণ্ডীতে আছে, তার সঙ্গে অন্যরাও। এখানকার মেয়েরা  যা রোজগার করে,সব তার হাতে তুলে দিতে হয়। না দিলে জামাকাপড় খুলে  রীতিমতো তল্লাশি চালানো হয়।  এই মল্লিকার বড় মেয়ে বিব্বোজান দেশের স্বাধীনতার জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে যারা লড়ছে, তাদের  লুকিয়ে সাহায্য করে । ছোট মেয়ে  আলমজেব কবিতা লেখে। সে এই পল্লির অংশ হতে চায় না। মণ্ডীর ভিতরে  এবার  এসে পড়ে ফরিদান।  সে দাঁড়ায় মল্লিকাজানের প্রতিপক্ষ হয়ে, উদ্দেশ্য মণ্ডীর ক্ষমতা দখল। কী হবে এরপর? তাই নিয়ে হীরামণ্ডী-র গল্প এগোয়।

অভিনয়ে প্রধান ভূমিকায় আছেন মণীষা কৈরালা, সোনাক্ষী সিনহা, রিচা চাড্ডা, অদিতি রাও হায়দিরি, সনজিদা শেখ, শরমিন সায়গল,  ফরিদা জালাল, প্রমুখ। প্রধান পুরুষ চরিত্রে আছেন ১৪ বছর পর পর্দায় ফেরা ফারদিন খান, শেখর সুমন, অধ্যয়ন সুমন, তাহা শাহ বাদুশা , তাঁরা করছেন যথাক্রমে ওয়ালি মহম্মদ, মুঘল নবাব জুলফিকার আহমেদ, জোরাভর আলি খান ও তাজদার বালোচ-এর চরিত্র।

ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে  ভালোবাসেন বনশালি, এবার বড়ো পরিসরে তার সুযোগ পেয়ে সদ্ব্যবহার করেছেন। পরাধীনতার বেড়ি কেটে ফেলছে  সমাজের এই ‘শ্রেণী’র মেয়েরা,  স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে, ভালোবেসে নবাবদের চৌহদ্দিতে সর্বস্ব সমর্পণ করছে আবার অন্ধকার মণ্ডীর জৌলুসের আবর্তে নিজেদের রানি ভেবে ক্ষমতার দখল নিয়ে চক্রান্ত করছে —সঞ্জয় এই বাজারের এতগুলো দিক তুলে ধরেছেন অনায়াসে।  সেই হিসেবে এই মেয়েদের  একটা  সম্মান দিল এই সিরিজ, যা ওদের প্রাপ্য ছিল। সিরিজের লেখক বনশালি, বিভু পুরী, মইন বেগ।  সংলাপ শ্রুতিসুখকর।  ‘মুজরাওয়ালি নহে, মুলকওয়ালি বনকে দিখাও’—এই চিন্তা থেকেই তো  তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া! বনশালি পারফেকশনে বিশ্বাস করেন।  এই জায়গাতেই কখনও ধাক্কা খেয়েছেন তিনি। গল্পের গতি মন্থর হয়েছে ডিটেলে যেতে গিয়ে।  সকলেই ভারি মেক আপে, সেজেগুজে আছে সব সময়, বিপ্লবীরাও। তাই অনেক সময় এসব আরোপিত মনে হয়। 

নায়িকাদের সাজপোশাক, গয়না,  তাদের বাড়ি, ঘর সবই দামি। বনশালির সব প্রজেক্টই দামি হয়, এটাও। নায়িকাদের পোশাকের দামের একটা আন্দাজ দেওয়া যেতে পারে। রিম্পল ও হরপ্রীত সিরিজের পোশাক ডিজাইন করেছেন। তাঁদের শাড়ির দাম সাধারণত হয় ২-৩ লাখ টাকা, আনারকলি সেট ৩.৫ লাখ। সেই হিসেবে হীরামণ্ডী-র নায়িকাদের লহেঙ্গার দাম এক একটি ২-৩ কোটি টাকা তো হবেই। সিরিজের জন্য ৩০০ লহেঙ্গা বানানো হয়েছে, সময় লেগেছে ২ বছর।

মণীষা কৈরালা হয়েছেন মল্লিকাজান।  সরল, পাহাড়ি সৌন্দর্য  নিয়ে তিনি ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছিলেন।  সেই মণীষা  নিজেকে আপাদমস্তক বদলে ফেলে মল্লিকাজান হয়ে উঠেছেন। তাঁর  ক্রুর দৃষ্টি, দেহভাষাতে  অত্যাচারী মনোভাব,  দারুণভাবে প্রকাশিত। সোনাক্ষী সিনহা ফরিদন হয়েছে।  বিব্বোজান হয়েছেন অদিতি রাও হায়দরি। তাঁর মুখে এবং চোখে একটা সহজাত উদাসীনতা, বিহ্বলভাব  আছে,  এই চরিত্রে দারুণভাবে ব্যবহার করেছেন তিনি। লজ্জো হয়েছেন রিচা চাড্ডা, কম সময়ের জন্য এলেও ছাপ রেখে যান। পুরুষ চরিত্রের মধ্যে  ফারদিন খানের ওয়ালি মহম্মদ ভালো লাগে। উস্তাদের চরিত্রে ইন্দ্রেশ মালিক অসাধারণ।

তবে পাকিস্তানে এই সিরিজ নিয়ে বিরোধ আছে।  সে দেশের অভিনেত্রী উশনা শাহ বলেছেন, ‘একজন ভারতীয় পরিচালক কী করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ছবি করতে পারেন…’ অভিনেত্রী মনসা পাশা বলেছেন, ‘…আমাদের দেশের হীরামণ্ডী নিয়ে তিনি বিদেশের মানুষকে বলছেন… খুবই দুঃখের।’ 

 এতে হীরামণ্ডী দেখার আগ্রহ কমার কোনও কারণ নেই। মুক্তির মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে বিশ্বের সবথেকে বেশি দেখা সিরিজের মধ্যে সেরা হয়েছে এই হীরামণ্ডী। ১৩টি  আঞ্চলিক  ভাষায় ও ৮টি বিদেশী ভাষায় সিরিজের ডাবিং হয়েছে, ফলে ৪৩টি দেশের প্রথম ১০টি  সেরা সিরিজে তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।  ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, বাহরিন, ইজিপ্ট, ইউএই, বাহরিন, সৌদি আরব, জর্ডন ও ইরাকে সমাদৃত হীরামণ্ডী। ফরাসি, জার্মানি, তাই ভাষার ডাবিং শিল্পীরাও ভারতীয় এই সিরিজ নিয়ে অভিভূত।  জার্মান ডাবিং শিল্পী ক্যাথরিনা স্কোয়ার্জমেয়ার বলেছেন, ‘হীরামণ্ডী দেখে আমি জিনস পরার কথা আর ভাবছি না। ’  এটাই পরিচালকের কৃতিত্ব।  তাঁর সব ছবিই বিদেশে আলো  জ্বালিয়েছে, এই সিরিজ দিয়ে তিনি প্রমাণ করলেন যথার্থ প্যান ইন্ডিয়ান প্রজেক্ট বানিয়ে বিদেশের  মাটিতে নিজেকে গ্লোবাল আইকন হিসেবে তুলে ধরেছেন।  

হীরামণ্ডী-র দ্বিতীয় ভাগ হবে না, সঞ্জয় তাও জানিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘এই কাজটা কঠিন ছিল। আর কেউ  হীরামণ্ডী  আর একবার বানাতে পারবে না, আমিও পারব না। এমন প্রজেক্ট একবারই হয়।’

ইতিহাসের সঙ্গে প্রেম মিশিয়ে জাঁকজমকের ভিতর দিয়ে পর্দা জুড়ে ফুটে ওঠা আলো আঁধারির ভিতর দিয়ে চলতে থাকা আলো  আঁধারের জীবন এমনভাবে একবারই দেখা যায়– সঞ্জয় লীলা বনশালি যে এভাবেই দেখেন, দেখানও!   


Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *