বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ

বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ
Spread the love

চিন্ময় নাথের লেখায় ও ছবিতে

দীর্ঘ দহনের শেষে বৃষ্টি নামলে মাটি ভিজে যায়। গাছেরাও দু’হাত বাড়িয়ে দেয় মেঘেদের দিকে। মাটি থেকে উঠে আসে অদ্ভুত এক সোঁদা গন্ধ। ভিজতে ইচ্ছে করে। করপোরেট অফিসের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে ইচ্ছে করে মেঘেদের সাথে হাত ধরে হেঁটে যাই দিকশূন্যপুরে। কিন্তু না, সে উপায় নেই। এ শহরের বুকে জেগে থাকা উঁচু উঁচু ইমারতের ছোট্ট ছোট্ট খোপ থেকে ভালো করে আকাশই দেখা যায় না। মেঘ-বৃষ্টির গন্ধ মুছে গিয়েছে আমাদের শরীর থেকে। রয়ে গিয়েছে
শুধুই কৃত্রিম পারফিউমের গন্ধ।

পেশার খাতিরে আমাকে লিখতে হবে, দীর্ঘ দহন শেষে বৃষ্টি ভেজা শহরের খবর। টানা তাপপ্রবাহ চলেছে দিন কয়েক ধরে। তীব্র দহন শেষে বৃষ্টির দেখা মিলতে চলেছে। বছরের প্রথম বৃষ্টি। ফলে আজ অন্তত এটাই ‘লিড’। লেখায় ফিল আনতে লিফটে করে নিচে এসে দাঁড়ালাম। মাথার ওপর আকাশটায় কালো স্লেটের মতো রং করে দিয়েছে কেউ। মেঘের পরে মেঘ জমেছে। জোরে হাওয়া বইছে। সামনে দেখলাম পাক খেয়ে ধুলো উড়ছে। পড়ন্ত বিকেলে সন্ধ্যার আবহ। সব আলো শুষে নিয়েছে বাউন্ডুলে মেঘের দল। মে মাস পড়ে গেল অথচ এ বছর একটাও কালবৈশাখি হয়নি। রাজস্থানের জয়শলমীরকে টেক্কা দিয়ে কলকাতায় বেয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রা উঠে গিয়েছে। গোটা শহরটা যেন নেতিয়ে পড়েছে গরমে। দিনভর তাপপ্রবাহ আর সন্ধ্যার পর হিউমিডিটির শাসন। গোটা শহরটাকে কেউ যেন রসগোল্লার রসে চুবিয়ে রেখেছে।

হঠাৎ এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া চোখে মুখে এসে ঝাপটা মারল। কোথাও বৃষ্টি পড়ছে। দু-এক ফোঁটা চোখে মুখে এসে পড়ল। আহা, শান্তি! মাটি থেকে উঠে এল সোঁদা গন্ধ। বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ। হাতে বেশি সময় নেই। নিউজ ডেস্কে ফিরে গিয়ে কপি লিখতে হবে। বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ….আহা, কী লিরিক্যাল। কিন্তু ইংরেজিতে একে এক কথায় কী বলে? কিছুতেই মনে পড়ছে না।

“দ্য ফাস্ট রেইন আফটার আ লং ড্রাই স্পেল ব্রিং আউট অ্যান আনমিসটেকেবল পারফিউম।” নাহ্,কপির বডিতে এটা লিখলেও হেডিং-এ অন্য কিছু চাই। ইংরেজিতে একটা শব্দে এটাকে কী বলে কিছুতেই মনে পড়ছে না। মগজের হার্ডডিস্কে রাখা ভোকাবুলারিতে ছানবিন চালাচ্ছিলাম। ঠিক তখনই পকেটে রাখা মোবাইলটা সুর করে বেজে উঠল। হোয়াটসআপ কল। নওশীন ফোন করেছে।

“ভাইয়া, কেমন আছো?” নওশীনের গলায় উত্তেজনার রেশ।

“এতো উত্তেজনা কীসের?” প্রথমেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলাম ওর দিকে। তারপর বললাম,“এই গরমে সিদ্ধ হতে হতে কোনোক্রমে বেঁচে আছি। তোমার কী খবর? অনেক দিন পরে মনে পড়ল আমায়।”

“কী বলো ভাইয়া,উত্তেজিত হব না? বছরের প্রথম বৃষ্টি। অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। প্রবল বৃষ্টিতে আটকে আছি। কেন, তোমাদের ওখানে বৃষ্টি হচ্ছে না? ঢাকার রাস্তায় তো জল জমে গেছে।”এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে একটু
থামল নওশীন।

নওশীন ঢাকার একটি খবরের কাগজে কাজ করে। আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে যোগাযোগ রাখাটা অনেক সহজ। ওকে বললাম,“ঢাকায় বৃষ্টি হচ্ছে? কলকাতায় এখনও পুরোপুরি নামেনি। তবে আকাশ সাজগোজ করে এসেছে। সন্ধ্যার পর নামবে বোধহয়। তুমি ওখান থেকে মেঘ পাঠাও। মেঘেদের তো পাসপোর্ট-ভিসা লাগে না। রাষ্ট্রের কাঁটাতার মেঘেদের জন্য নয়।”

আমার কথা শুনে হেসে উঠল নওশীন। “পাঠাচ্ছি ভাইয়া। গোটা ঢাকা শহর যানজটের কবলে। বৃষ্টিতে অবরুদ্ধ। তোমরা কিছুটা মেঘ নিলে এখানে বৃষ্টির বেগ কমবে।”

“পাঠাও,পাঠাও। আমরা তো গরমে জ্বলে পুড়ে মরছি।”একটু থেমে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তা তুমি কোথায় আটকে আছো?”

“গুলশনে।”

“ওয়ান, না টু?

“ওয়ান”

“বাহ্,বাটার কাছে?”

খানিকটা অবাক হয়ে নওশীন আমায় পাল্টা জিজ্ঞেস করল,“অ্যাই,তুমি কি ঢাকায়?”

“যা বাবা! এর সঙ্গে আমি ঢাকায় না কলকাতায় এর কী সম্পর্ক?”

“না,মানে, তুমি জানলে কী করে আমি বাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি?” নওশীনের গলায় কৌতূহল।

ওর কৌতূহলকে পাশ কাটিয়ে বললাম, “আরে মনে করো না আমিও এই মুহূর্তে ঢাকার রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজছি। মনে করো তোমার হাতে ছাতা নেই। কিংবা থাকলেও সেটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলো একসাথে ভিজে যাই। বছরের প্রথম বৃষ্টি বলে কথা! তোমার মতো সুন্দরী যুবতীর সাথে বৃষ্টিতে ভেজার থ্রিলটা উপভোগ করতে চাই।”

“কী ব্যাপার ভাইয়া,হঠাৎ এতো রোমান্টিক হয়ে উঠলে যে? আজ কী ড্রাই ডে? খবর-টবর কিছু নেই?”

“ধুর, ছাড়ো তো তোমার খবর? সেই এক থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি।” কথাটা শেষ করতেই আমার মাথায় ঘাই মারল ‘বৃষ্টি ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ’। ইংরেজিটা কী যেন? আঃ, কিছুতেই মনে পড়ছে না!

“ভাইয়া, চুপ করে গেলে কেন? হ্যালো,হ্যালো…”

নওশীনকে আশ্বস্ত করে বললাম,“লাইনে আছি,বলো।”

“তুমিই তো বলছিলে একসাথে ভেজার কথা।”

“ভিজব তো। একসাথে ভিজব। হাওয়ায় বেগে ছাতা উড়ে যাবে। গাছেদের মতো করে ভিজব।”

“বেশ ভিজলাম। তারপর?” নুপুর পরা বৃষ্টি কিশোরীর মতো হেসে উঠল নওশীন।

“তারপর…উমম…তারপর হান্ডিতে খাব। বাটার কাছেই তো হান্ডি রেস্টুরেন্ট। তিনতলায় বসে কাচের দেওয়ালের ওপারে বৃষ্টি দেখব আর…”

আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে নওশীন বলে উঠল,“খাড়াও,খাড়াও ভাইয়া,বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বরে পড়বা।”

বেশ জোরের সঙ্গে বললাম,“রাখো তোমার জ্বর। নিউমোনিয়া হলেও পরোয়া করি না।”

আবার সেই নুপুর পরা বৃষ্টি কিশোরীর মতো হাসি শুনতে পেলাম ফোনের ওপারে।

“আচ্ছা বেশ, গুলশনের হান্ডিতে খেলাম, তারপর কী করবা?”

“তারপর চলে যাব হাতির ঝিল।”

“কীভাবে যাবা? এই বৃ্ষ্টিতে রিকশ তো পাবা না। সিএনজি নেই একটাও।”

আমি প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠলাম,“রাখো তোমার রিকশা, অটো, ক্যাব। হেঁটে যাব, হেঁটে। ওইটুকু তো পথ। ফুটপাথ ধরে হাঁটব। ভালোই তো হবে এই বৃষ্টিতে ফুটপাথে কোনো হকারও থাকবে না। ফাঁকা রাস্তা।”

“তারপর কী হাতির ঝিলের ধারে বসে বৃষ্টিতে ভিজে কবিতা লিখবা? আমি কিন্তু আর ভিজতে পারব না বলে দিলাম।”

“আরে ধুর,কাব্য করে কী হবে? ওখান থেকে ফেরি সার্ভিস ধরব!”

“ফেরি সার্ভিস! যাব কোথায়?” নওশীনের গলায় একরাশ বিস্ময়।

“কেন? রামপুরা।”

“রামপুরা? সে কীঁ! অতদূর রামপুরায় গিয়ে কী করব?”

“কোথায় অতোদূর? পুলিশ প্লাজার পরেই তো রামপুরা।”

গুলশন থেকে রামপুরা? ওখানে যানজট আরও বেশি। রিকশর গুঁতো খেতে পারব না ভাইয়া, বলে দিলাম।”

“আরে,রামপুরায় মধুবনের মিষ্টিটা খাব না? মিষ্টিমুখ করে তবে তো আলবিদা বলব নাকি?”

“ভাইয়া, তোমার মধুবনের মিষ্টির কথা মনে আছে?” খুব দ্রুত কথাগুলো বলে উঠল নওশীন।

আছে আছে, সব মনে আছে নওশীন। মন তো কোনো বাধা মানে না। মনকে কোনো রাষ্ট্রের বিধিনিষেধ বা কাঁটাতারের বেড়াজালে আটকে রাখা যায় না। মন তো মেঘেদের মতই। বাউন্ডুলে। শুধু খোলা আকাশে উড়তে চায়।

একটু অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিলাম। নওশীন কিছু একটা বলছিল। এমন সময় একটা তীব্র নীলাভ রেখা সেক্টর ফাইভের আকাশটাকে ফালাফালা করে দিয়ে চলে গেল। কান ফাটানো আওয়াজে বাজ পড়ল কোথাও। আর অমনি ফোনটা
কেটে গেল। বড়বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামল। আমি তীর বেগে দৌড়লাম লিফটের পেটের ভেতর ঢোকার জন্য। বৃষ্টি ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধটা ফিরে এল। ঠিক তখনই মগজের ভেতর ভোকাবুলারিটা জেগে উঠল। মনে পড়ে গেল ইংরেজি শব্দটা “পেট্রিকর”। মনে মনে বলে উঠলাম, “ইউরেকা… ইউরেকা।” আসলে বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধটা কখনও পাল্টায় না, সে ঢাকা হোক বা কলকাতা।


Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *