রন্তিদেব সেনগুপ্ত
পেটকাটি, চাঁদিয়াল, চৌরঙ্গী, মোমবাতি, মুখপোড়া – ভালোবেসে এই সব নামগুলি এখন কেউ উচ্চারণ করে কি না কে জানে! আমরা করতাম, সেই আমাদের বালকবেলায়। তখন বাংলা ক্যালেন্ডারে ভাদ্রমাস পড়লেই আমাদের ঘুড়িচর্চা শুরু হয়ে যেত। ঘুড়ি নিয়ে সে কী সাজসাজ রব আমাদের উত্তর কলকাতার আলোআঁধারি ঘেরা পাড়াটিতে। এক ল্যাম্পপোস্ট থেকে শুরু করে আর এক ল্যাম্পপোস্টে সুতো বেঁধে মাঞ্জা দেওয়া শুরু হত। কার মাঞ্জা কত ধারালো হয় সেই তখন থেকেই তার প্রতিযোগিতা। আমাদের পাড়ার হারু, যাকে আমার কাকারা হাউরা বলে ডাকত, সে নাকি সব থেকে ভালো মাঞ্জা দিতে পারত। সবাই বলত হারুর মাঞ্জা এত ধারালো যে, আকাশে ওর ঘুড়ির সঙ্গে আর কেউ টক্কর দিতে পারে না। মাঞ্জা দেওয়ার ব্যাপারে হারু সত্যিই খুব সিরিয়াস ছিল। যখন মাঞ্জা দিত তখন কারো সঙ্গে কথা বলত না। গম্ভীর মুখে মাঞ্জা দিয়ে যেত।
আমাদের বাঙাল বাড়িতে ঘুড়ি ওড়ানোয় সব থেকে বেশি উৎসাহ ছিল রঞ্জুকাকুর। ভাদ্র মাস পড়লেই রঞ্জু কাকু জিজ্ঞেস করত, ‘গদন, এইবার কোন ঘুড়িটা আনুম ক’। পেটকাটি, না চাঁদিয়াল। তুই যেইটা কবি হেইডা আনুম।‘ আমি কোনোবার বলতাম পেটকাটি, কোনোবার চাঁদিয়াল, কোনোবার বা চৌরঙ্গী। ফরমাশ করার সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জুকাকু আমাকে নিয়ে ফড়িয়াপুকুর যেত। ডজন দরে ফড়িয়াপুকুর থেকে ঘুড়ি কিনে আনতাম আমরা। কোনো কোনো ঘুড়িতে রঞ্জুকাকু কাগজ কেটে লম্বা লেজ বানিয়ে লাগিয়ে দিত। কোনো কোনো ঘুড়ির সঙ্গে আবার চিরকুটে দু’লাইনের পদ্য লিখে সেঁটে দেওয়া হত। এরকম একটা পদ্য আমার এখনো মনে আছে –
পুঁইট্যা খা, খুঁইট্যা খা
নিজের মাথা নিজে খা।
ঘুড়ি ওড়ানোর ব্যাপারে আমার সেজোকাকারও যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। তবে, রঞ্জুকাকু যখন ঘুড়ি ওড়াতো তখন রঞ্জুকাকুকে উৎসাহ দেওয়াতেই বেশি আগ্রহ ছিল তাঁর। রঞ্জুকাকু ঘুড়ি ওড়াতো আর সেজোকাকা পিছনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলত, ‘রঞ্জু রঞ্জু, ডাইন দিকে টান, ডাইন দিকে টান। ওই দিকে একখান চাঁদিয়াল আছে। দে হালারে কাইট্যা।‘ আর রঞ্জুকাকু যদি একবার প্রতিপক্ষের ঘুড়ি কাটতে পারত, তাহলে আমার সেজোকাকার উৎসাহ দেখে কে! দু হাত আকাশের দিকে তুলে উদ্দাম নৃত্য শুরু করত। বলত, ‘কাইট্যা ফ্যালাইছে, কাইট্যা ফ্যালাইছে। হালারে ঠিক কাইট্যা ফ্যালাইছে রঞ্জু।‘
আমরা অবাক বিস্ময়ে ঘুড়ি ওড়ানো দেখতাম। রঞ্জুকাকু কোনো ঘুড়ি কাটলে আমাদেরও খুব আনন্দ হত। আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠতাম আমরাও। আবার রঞ্জুকাকুর ঘুড়ি কাটা পড়লে আমাদের মুখে বিষাদের মেঘ ঘনিয়ে আসত। আমাদের এই হর্ষ এবং বিষাদের আরও একজন সঙ্গী ছিল। আমাদের মনীষা কাকিমা। ভালোবেসে রঞ্জুকাকু বিয়ে করেছিল মনীষা কাকিমাকে। খুব সুন্দরী ছিল মনীষা কাকিমা। সেই বালকবেলায় আমাদের যাবতীয় আবদার ছিল মনীষা কাকিমার কাছে। হাসিমুখে মনীষা কাকিমা সেই সব আবদার মেটাতো। বালকবেলায় আমাদের খেলার সঙ্গীও ছিল মনীষা কাকিমা। রঞ্জুকাকু যখন ঘুড়ি ওড়াতো মনীষা কাকিমা মাঝে মাঝে আবদার করে লাটাই ধরত। আমাকেও মাঝে মাঝে লাটাই ধরতে দিত রঞ্জুকাকু। বলত, ‘গদন, তুইও এট্টু লাটাই ধর।‘
তবে হুল্লোড়টা সবথেকে বেশি হত বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। ওই দিনটা আমাদের বাঙাল বাড়িতেও কিছু কম উৎসবের দিন ছিল না। সেদিন সকাল থেকেই ছাদে ঘুড়ি ওড়ানোর তোড়জোড় শুরু হত। আর সেদিন আমাদের বাঙাল বাড়িতে আস্ত গোল গোল আলু দিয়ে পাঁঠার মাংস রান্না হতই। মানিকতলা বাজার থেকে পাঁঠার মাংস আসত। ছাদে সকাল থেকে রঞ্জুকাকু আর সেজোকাকার ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হত। মাঝে মাঝেই আমার পিসিরা বা মনীষা কাকিমা এসে চা দিয়ে যেত। তারই সঙ্গে ঘরে বানানো নিমকি বা পেঁয়াজি। সে রীতিমতো হইহই ব্যাপার। সেদিন ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য পড়াশোনা থেকে ছুটি পেতাম আমরা।
আমাদের পাড়ায় ঘুড়ি উড়িয়ে বেশ নাম করেছিল নবাঙ্কুর সংঘের মাঠের পাশে তেতলা বাড়ির কুন্ডুরা। কুন্ডুদের ঘুড়ি আকাশের অনেক ওপরে উড়ে যেত। দেখাই যেত না সেই ঘুড়িকে। সেখান থেকে অকস্মাৎ চিলের মতো নেমে এসে ছোঁ মেরে কেটে দিয়ে যেত প্রতিপক্ষের ঘুড়ি। ঘুড়ি ওড়ানোয় নামডাক ছিল আমাদের উলটো দিকের বাড়ির সম্বল – ভোম্বলদের। ওদের ঘুড়িও চট করে কাটা পড়ত না। ওরা আবার ঠাট্টা করে রঞ্জুকাকুকে বলত, ‘কাকু তোমার ঘুড়ি না কাটলে আমাদের সন্ধেবেলা কী খাওয়াবে?’ রঞ্জুকাকু হেসে বলত, ‘যদি না কাটস, তয় ঠিক খাওয়াইমু তগ।‘ কথা রাখত রঞ্জুকাকু। সন্ধেবেলা অনাথের দোকান থেকে মোগলাই পরোটা এনে খাওয়াত ওদের। অবশ্য আমাদের জন্যও মোগলাই পরোটা আসত। সন্ধেবেলা সকলে গোল হয়ে বসে মোগলাই পরোটা খেতে খেতে হিসেব-নিকেশ হত সারাদিনে কে কটা ঘুড়ি কাটল, কার কটা ঘুড়ি কাটা পড়ল।
বিশ্বকর্মা পুজোর দিন আরও দুটো জিনিসের জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম আমরা। প্রথমটি হল, দেব সাহিত্য কুটিরের মোটা বাঁধানো ছোটদের পুজোবার্ষিকী। এক এক বছর এক এক নামে বেরত সেটা। এখন আর সে নামগুলো মনে নেই। কিন্তু এটুকু মনে আছে সে পুজোবার্ষিকী এসে পৌঁছনোমাত্রই বগলামামার গল্পটি পড়ার জন্য আমাদের দু’ ভাইবোনের ভিতর কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। দ্বিতীয়টি হল, এক থালা ভরতি লাড্ডু আর সোনপাপড়ি। আমাদের পাড়ায় ভরতবাবুর ছাপাখানা ছিল। ঘটাং ঘটাং শব্দ তুলে সেই লেটারপ্রেসে সারাদিন পোস্টার আর হ্যান্ডবিল ছাপা হত। সারাদিন পর সন্ধেবেলা প্রেস বন্ধ করে বাড়ি ফেরার পথে ভরতবাবু এসে আমার দাদুর সঙ্গে দু দণ্ড গল্পগাছা করে যেতেন। ভরতবাবুদের দেশ ছিল ফরিদপুরে। আর আমার দাদুর বাসা ছিল ঢাকার বলধা পাড়ায়। ভরতবাবুর প্রেসে বিশ্বকর্মা পুজো হত। বিকেলের দিকে সেই প্রেস থেকে থালা ভরতি লাড্ডু আর সোনপাপড়ি এসে পৌঁছত আমাদের বাড়িতে। আমার ঠাকুমার একটু বেশি পক্ষপাতিত্ব ছিল আমার প্রতি। ফলে সেই লাড্ডু আর সোনপাপড়ির একটা বড় অংশই যেত আমার দখলে।
উত্তর কলকাতায় আমাদের সেই শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িটি এখন পরিত্যক্তপ্রায়। আর কিছুদিন পরে সে বাড়ি ভেঙে ফেলে প্রোমোটার নতুন ঝাঁ চকচকে বাড়ি গড়ে তুলবে। ওই পরিত্যক্তপ্রায় বাড়ির ছাদে এখন আর কেউ ঘুড়ি ওড়ায় না। কলকাতার যে অংশটিতে এখন আমি থাকি, সেখানে এখন ভাদ্র মাসে আতিপাতি করে খুঁজেও বড়জোর একটা দুটোর বেশি ঘুড়ি আকাশে খুঁজে পাইনি। আমি যে পাড়ায় থাকি এখন সেখানে ভোঁকাট্টা শব্দে কেউ আকাশ বাতাস মুখরিত করে দেয় না। রঞ্জুকাকু, সেজোকাকা, মনীষা কাকিমা সবাই এখন দূর আকাশের নক্ষত্র। ফড়িয়াপুকুর থেকে ডজন দরে ঘুড়ি কিনে আনার দিনগুলিও আমার কবেই চলে গেছে।
তবু, ওই ভাদ্র মাস পড়লে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। বরষা চলে যাওয়ার মুখে হালকা মেঘের দল ভেসে বেড়ায় আকাশে। কোথাও কোনো ঘুড়ি চোখে না পড়লেও আমি নিজের মনেই বলে উঠি, ভোঁ কাট্টা …….
উৎসব, এই পড়ন্ত বেলায়, আমার জীবনেও এসে উঁকি মারে।