লিখেছেন- সফিউন্নিসা
একশো বছর পেরিয়ে গেছে অনেকদিন। সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাবিত, রাষ্ট্রসঙ্ঘ অনুমোদিত ৮ মার্চ নারীদিবসের ঘোষণা মোতাবেক সারা বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর এই দিনটি উৎসবের মতো পালিত হয়ে চলেছে। এবং ক্যালেন্ডারের একটি বিশেষ দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। কী হল নারীর সমানাধিকার প্রাপ্তির বিষয়টি? ভোটাধিকারের দাবিতে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তা পেতেও তো বিশ্বের নানাদেশের নারীদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল অনেক বছর! তারপরে তো গঙ্গা-পদ্মা-ওব-দানিউব দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। নারীদের কেন আজও শুধুমাত্র নারীদিবসের প্রথাপালনের দিনটিতে অপ্রাপ্তি আর বঞ্চনা নিয়ে আলোচনা আর সেমিনারে সীমাবদ্ধ রাখতে হয় যাবতীয় দাবি? তিন দশক পেরিয়ে গেলেও আমাদের রাজনীতিতে ৩৩ শতাংশ নারীর জন্য বরাদ্দ কথার কথাই রয়ে গেল?
সামাজিক চিত্র আরও ঝাপসা হয়েছে। মেয়েরা যুদ্ধবিমান চালাতে পারলেও এখনও নিজের শরীরের ওপর অধিকার পায়নি। অ্যাবরশনের অধিকার আদায়ের দাবিতে খোদ আমেরিকাতেও নারীদের পথে নামতে হয় আজও। সারোগেসির জন্য মেয়েদের ব্যবহার করা হয়। কম ক্ষেত্রেই তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা মূল্য পায়। যুদ্ধবাজ দেশগুলি সেনা তৈরির প্রয়োজনে নারীদের বেশি বেশি সন্তানধারণের হুকুমনামা জারি করে। নারীরা কী চায় তার তোয়াক্কা না করেই। সমকাজে সম মজুরির অন্যতম দাবি ছিল নারীদিবসে। আমাদের মেয়েদের এখনও বরাদ্দের দুই তৃতীয়াংশ মজুরিতে অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে কাজ করে যেতে হচ্ছে। কৃষি এবং দিনমজুরির ক্ষেত্রে তো বটেই ইটভাটাসহ বহু ছোটখাট কলকারখানাতে একই ছবি। তেভাগা আন্দোলনের পুরোধা, চরম অত্যাচারিত, পুলিসের হাতে চরম লাঞ্ছিত নেত্রী প্রয়াত ইলা মিত্র তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন—‘ স্বাধীনতা শব্দটি বড়ই বেয়াড়া। চলতি মানে স্ব-অধীনতা বা নিজের দায়দায়িত্ব একেবারেই নিজের। অর্থাৎ একটা জনগোষ্ঠীরও স্বাধীনতার বোধ থাকার কথা—যার মানে সে জনগোষ্ঠী তার আত্মনিয়ন্ত্রণের সবটুকু অধিকার ভোগ করে। সেখানে থাকে সার্বভৌমত্ব।…… শোষণহীন মুক্ত শ্রমই স্বাধীনতার স্বাদ দেয়। ব্যক্তিমানুষের কথাও সেখানে আসে—বিশেষভাবে মেয়েদের কথা। মানুষের দু‘রকম মর্যাদা থাকে।
শারীরিক মর্যাদা, অন্তর্গত মন ও মননের মর্যাদা। ……শ্রেণিবিভক্ত সমাজে মেয়েদের কি দেহ ও মনের স্বাধীনতা থাকে ? ……যে মেয়েটি শারীরিক সম্মানের অধিকারিণী নয়, যার শরীরের উপর আইন ও সামাজিক অধিকার তার স্বামীর, তার শ্রমটুকু নেবার অধিকার তার পরিবারের এবং সে বংশবৃদ্ধির জন্য কাঁচা মালকে পাকা করার জরায়ুর অধিকারিণী। ……জাঁ পল সাত্রে একবার সীমন দ্য বোতায়াকে বলেছিলেন যে রাষ্ট্রপতির গৃহিণী সবার কাছে খুব মর্যাদা পান—তিনি রাষ্ট্রের প্রথম মহিলা বলে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি যখনই পদচ্যুত হলেন বা মারা গেলেন, সে মহিলাকে আর তখন কে পোঁছে? তাঁর তো একজন টাইপিস্টের কাজও জানা নেই। মেয়েদের সম্মান এমনই ঠুনকো।’ মেয়েরা কি লড়াইয়ে পশ্চাৎপদ? বরং উলটোটা। বরাবরই যে কোনও আন্দোলনে সরাসরি সবসময় না হলেও সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নেয় মেয়েরাই। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন বারবার মনে করিয়ে দেয় সেকথা। কিন্তু সেইসব নারীদের কথা ইতিহাসে সেভাবে গুরুত্ব পায়না কেন তার স্পষ্ট উত্তর হল, পুরুষশাসিত সমাজের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি। ১৮৬০ সালে ইন্ডিয়ান ফিল্ড নামে একটি মাসিক পত্রিকায় এক জার্মান পাদ্রি লিখেছেন—‘ তীর ধনুক, কাঁচা বেল, ইট-পাটকেল ছাড়াও গৃহস্থালীর নানা সরঞ্জাম—যেমন ভাত খাওয়ার কাঁসার থালা, ও খুব ভালো করে পোড়ানো মাটির বাসনকোসন ইত্যাদি নিয়ে তারা নীলকর-ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীকে আক্রমণ করত। স্ত্রীলোকেরা ঐ সব অস্ত্র উত্তমরূপে ব্যবহার করতে জানত। নীলকরেরা যখন দেখতে পেত স্ত্রীলোকেরা ওইসব অস্ত্র-সজ্জিত হয়ে তাদের দিকে ছুটে আসছে—তখন তারা প্রাণভয়ে পালিয়ে যেত।’
তেভাগা আন্দোলনের শুরুটা পরাধীন ভারতে হলেও তার বিস্তৃতি তো স্বাধীন ভারতেই ঘটেছিল। সেদিন মেয়েরা প্রবল শক্তি নিয়ে উচ্চারণ করেছিল—‘জান দেব তবু ধান দেব না।’ এইসব মেয়েরাই নেতাদের রক্ষা করত চরম গোপনীয়তায়। মেয়েরা কীভাবে অসম সাহসিকতায় এগিয়ে আসত তা ১৯৪৬ সালের এক ঘটনায় কৃষক আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত বীণা গুহ লিখেছেন—‘ এমনই এক নারীবাহিনী বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করেছিল ২০শে পৌষ অটোয়ারি থানার রামপুর মালানি গ্রামে। পুরুষরা ধান কাটছে, মেয়েরা ধানখেতের আলের উপর দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। সশস্ত্র ফৌজ মেয়েদের বাধা সত্ত্বেও এগিয়ে আসার চেষ্টা করে। দুর্ধর্ষ মেয়েরা তখন হাতিয়ার নিয়ে ফৌজের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গাইন দিয়ে পিটিয়ে ফৌজের ৫/৬ টি বন্দুক ভেঙে দেয়। শত শত মেয়ে ভলান্টিয়ারের প্রতিরোধে পুলিশ পিছু হটতে বাধ্য হয়। বাহিনীর নেতৃত্ব দেয় জয়মণি ও রোহিণী বর্মণী।’ মনে রাখতে হবে, এই আন্দোলনকে হাজংরা তীব্রতম মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম যখন প্রায় অন্তিম পর্বে সেই সময়ে ৩১ জানুয়ারি ইংরেজ সরকারের পুলিস হানা দিতে শুরু করে গ্রামে গ্রামে। পুরুষরা আত্মগোপন করায় মেয়েদের ওপর পশুশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা। নেত্রকোনার বাহিরতলী গ্রামে সরস্বতী নাম্নী এক যুবতীর শ্লীলতাহানি করে তারা। এই ঘটনা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে হাজংদের মধ্যে। নেত্রী রাসমণি বিরাট এক নারীবাহিনী নিয়ে ব্রিটিশ সেনা ছাউনির দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। আধুনিক অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত ইস্টার্ন রাইফেলধারী ফৌজিদের সঙ্গে তিনঘন্টাব্যাপী অসম যুদ্ধ চলে রাসমণিদের। প্রাণ যায় রাসমণি, শঙ্খমণি, রেবতী, নীলমণি, পদ্মমণিসহ অসংখ্য নারীর। ইতিহাস এঁদের মনে রাখেনি।
স্বাধীন ভারত ৭৫ বছরে সমৃদ্ধ হয়েছে নানাভাবে। নারীজগৎও পেয়েছে যৎকিঞ্চিৎ। তবু নারীর অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায় বারবার। তাদের কাছে সমাজগঠনের কাজে কতটা ডাক আসে জানা যায় না। জানা যায় মাঝরাত্তিরে দুষ্কৃতীদের পিঠে বানিয়ে দেবার ডাকে সাড়া দেবার বাধ্যবাধকতার কথা। নারীদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কি সত্যিই এমন তলানিতে ঠেকেছে যে দিনের পর দিন এই নাটক তারা মুখ বুজে সহ্য করেছে! শেষ পর্যন্ত তো সেই তারাই জেগে উঠল একসঙ্গে! তাহলে এই অবাঞ্ছিত সুযোগ দীর্ঘদিন ধরে কেন তারা দিয়েছিল ? আবারও প্রশ্ন উঠে যায়, তাদের কথা কেন বারবার চাপা পড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে রাজনীতির কারবারিদের চাপান-উতোরের ইতর খেলায়? কেন তাদের বলতে দেওয়া হচ্ছেনা তাদের ভাষায় তাদের বক্তব্য? নারীদিবসের সব আয়োজন বড় বেশি কাগুজে হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনের জগৎ-সংসার যাদের ছাড়া অচল, তাদের আলাদা একদিনের দিবস কেন? প্রতিদিন হোক স্বাভাবিকতায় নারীদিন—মানুষের দিন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অধিকার বুঝে নেবার দিন। সে অধিকার মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্মগত অধিকার।