বাংলা ভাষার কী গতি হবে? (শেষ পর্ব)

বাংলা ভাষার কী গতি হবে? (শেষ পর্ব)
Spread the love

বিশিষ্ট ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের ধারাবাহিকের শেষ পর্ব

যে খবর একটু আগে আমরা দিয়েছি যে, এখন সরকার নাকি ভাবছে দেশি ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হবে। আমরা জানি না, প্রথমত, সরকার অভিন্ন শিক্ষা বা সেই common school system-এর কথা ভাবছে কি না। সরকার এ কথা খোলসা করে বলেনি। আমরাও বুঝছি না যে, তার জন্য সরকারের যে সাহস আর সম্বল দরকার তা সরকারের আছে কি না। তা হলে বেসরকারি স্কুলগুলিকেও সরকারি দেশি-ভাষার সিলেবাসের আওতায় আনতে হবে। সে ক্ষমতা সরকারের আছে ? দ্বিতীয়ত, কতদূর পৌঁছোবে দেশি ভাষার মাধ্যম ? সরকারের নতুন শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে grade eight and beyond. এই Beyond মানে ঠিক কী ? অবশ্যই ধাপে ধাপে এগোতে হবে এই আকাঙ্ক্ষাকে, কিন্তু এই ধাপের পরিসর কত বড় হবে ? আট ক্লাস পর্যন্ত শুধু দেশি ভাষা তো এখনও নেই অনেক রাজ্যে। কত দিনে আট ক্লাস হবে, তার পর দশ ক্লাস, বারো ক্লাস করে স্নাতকোত্তর বা পিএইচ ডি পর্যন্ত পৌঁছোবে ? তার পর তৃতীয়ত, সব বিষয় শেষ পর্যন্ত পড়ানো হবে মাতৃভাষায় ২ ? এটা ২০২৪এর নির্বাচনি ‘জুমলা কিনা তাও আমাদের পক্ষে বোঝা মুশকিল।

তা হলে মাতৃভাষার কি  কোনও একটা হিল্লে হয়েছে বা হবে ? এত দিন সরকারি স্কুলে তার একটা ঠাঁই ছিল, এখন পশ্চিম বাংলায় শুনি সরকারও নাকি তার পোষিত কিছু স্কুল ইংরেজি মাধ্যম করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। সরকারকে এই সর্বনেশে সত্যটা বুঝতে হবে যে, ইংরেজি মাধ্যমে যারা পড়বে তাদের সকলের কাছেই মাতৃভাষা অবান্তর না হলেও তুলনায় তুচ্ছ হয়ে যাবে। স্কুলও যখন উদ্ধতভাবে বলে যে স্কুলে ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা (নিজের ভাষা) বলা চলবে না, বাড়িতেও ইংরেজি-জানা (!) মা-বাবা প্রাণপণে সন্তানকে বাধা দেন ইংরেজির বদলে বাংলা বলতে। বাঙালির সন্তান তাই বাংলাটাকে ভীষণ কঠিন ভাবে, তাদের বাপ-মাদেরও ধারণা, তিনটে ‘শ’ আর দুখানা ‘ণ’ আর যুক্তব্যঞ্জন নিয়ে বাংলাটা একটা বিতিকিচ্ছিরি বর্বর ভাষা। বাঙালি হয়ে জন্মানোর জন্য নিজেদের অভিশপ্ত বোধ করে। ইংরেজির কোনও দোষ বা সমস্যা তারা দেখে না। আবার এও তারা দেখে যে, প্রশাসনিক আর অন্যান্য কাজে বাংলাভাষায় ব্যাপক ব্যাবহারের ঝন্য সরকারের কোনও উদ্যোগ নেই, কলকাতা পুরসভার লোকেরা পথে পথে I love Benepukur বলে আলোর বিজ্ঞাপন দেয়,’ লাভ্’-এর জায়গায় লাল হৃদয়ের ছবি দিয়ে। কবে আমরা নিজেদের ভাষাকে শ্রদ্ধা করতে শিখব ? ফলে এই ভয় ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছে যে, বাঙালি ছেলেরা ক্রমশ বাংলার প্রতি বিমুখ হবে, অভিভাবকদের প্ররোচনায় বাংলা কম শিখবে। তখন এত পত্রপত্রিকা, এত বিপুল সাহিত্য—সে সবের পাঠক কোথায় পাব ?  সরকার আরও যা করতে পারে, তা হল, বাংলা স্কুলে ভালো করে ইংরেজি শেখার ব্যবস্থা। বাংলা বা নিজের ভাষায় ছেলেমেয়েরা যতদূর ইচ্ছে পড়ুক, কিন্তু ওসব স্কুলে তাদের ইংরেজি ভাষাটা যেন আরও ভালো করে শেখানো হয়। সাহিত্যের পাঠ নয়, ভাষাটা বলা আর লেখার পাঠ। তার জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যাঁরা চল্লিশ বছর আগে ক্লাস ওয়ান থেকে ইংরেজির জন্য আন্দোলন করেছিল, ২০০১-এ তাদের ইচ্ছা ও স্বপ্ন তো পূরণ হয়েছে। তবে এখনও ইংরেজি মাধ্যমের জন্য হাহাকার কেন ? বাংলা ভাষা ক্লাসিকাল মর্যাদা পেল বা না পেল, তাতে আপাতত এ ভাষার কিচ্ছু এসে যায় না। অন্য ভাষার লোক বাংলার স্কুলে বাংলা পড়ল কি না তা নিয়েও আমি চিন্তিত নই। আমি চিন্তিত বাঙালির ছেলেমেয়ে স্কুলে বাংলা পড়ল কি না। এ ভাষা স্কুলে- কলেজে মাধ্যম হিসেবে থাকছে কি না, সরকার নানা কাজে ব্যবহার করছে কি না, বাড়িতে বাবা-মায়েরা সন্তানদের বাংলা বলতে ও পড়তে-লিখতে উৎসাহ দিচ্ছেন কি না, এমনকি রাস্তায় বিজ্ঞপ্তিতে সাইনবোর্ডে ছেলেমেয়েরা বাংলা লেখা দেখছে কি না—তাতে এ ভাষার, যে কোনও ‘মাতৃভাষার’—সেটাই গভীর চিন্তার বিষয়। সরকার আর নাগরিকেরা, এবং আন্দোলনকারীরাও, এক সঙ্গে মিলে এই কথাটা ভাবুক। আবার বলি, এই লেখা কোনওক্রমেই ইংরেজি ভাষা না-শেখানোর পক্ষে ওকালতি নয়। পুরোদস্তুর উন্মাদ না হলে সে সুপারিশ কেউ করতে পারে না। আমরা শুধু চাই, ভবিষ্যতে কোনও একটা (অস্পষ্ট) সময়ে -মাতৃভাষা সর্বস্তরে সব রকম শিক্ষার মাধ্যম হোক, কিন্তু ভারতের ছেলেমেয়েরা সেই সঙ্গে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজিও খুব ভালো শিখুক। ইংরেজি সাহিত্য নয়, আধুনিক ইংরেজি ‘ভাষা’—তার মৌখিক আর লিখিত দুটি রূপই। যারা চায় তারা ভাষাপাঠ থেকে সাহিত্যের দিকে এগোবে।

টীকা

১. হায়দরাবাদের সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট ফর ফরেইন ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজের ডিরেক্টর অধ্যাপক প্রমোদ তালঘেরি যেমন একবার এ লেখককে বলেছিলেন, Indian vernaculars are doomed. আমি তাঁর কথার প্রতিবাদ করেছিলাম, কিন্তু তিনে কথাটা দুঃখের সঙ্গেই বলেছিলেন। যাই হোক, ‘ডুম্ড’ বলে তো বসে থাকলে চলবে না, লড়াইটা তো চালাতেই হবে। যেখানে লেপচার মতো ভাষাও বিলুপ্তি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে, প্রাথমিক স্কুলে মাধ্যম হিসেবে জোর করে চালু করেছে, সেখানে বাংলাকে বা ভারতের অন্য প্রধান ভাষার এত সহজে হাল ছেড়ে দিলে হবে ?

২. সত্যের খাতিরে বলতেই হবে যে, লোরেটো (এক বিখ্যাত ‘কনভেন্ট’ স্কুল ও কলেজ) কোনও দিনই দেশি ভাষা মাধ্যমে পড়ায়নি। সরকার আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তা জানত না এমন দাবি করলে সেটা আমাদের বিশ্বাস করা কঠিন হবে। তারা এতদিন এই ব্যবস্থা সম্বন্ধে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। কাজেই লোরেটো কলেজ তাদের বিজ্ঞপ্তিতে সাদা সত্য কথাই বলেছে শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য। কিন্তু এটা নিয়ে এত হইচই হল যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও নড়েচড়ে বসল, এবং তাদের বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করল। এতে যে জায়গাটা এখনও স্পষ্ট হল না তা এই যে, পশ্চিম বাংলার সমস্ত ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও কলেজে দেশি ভাষার মাধ্যম চালু হবে কি না। নাকি শুধু লোরেটোকে গণ-ধিক্কারের চাপে এই ব্যবস্থা বাধ্য হয়ে গিলে নিতে হল। সরকার বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে এ বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করা দরকার। তারা কি তা করবে ? লোরেটো কি এবার হিন্দি বা বাংলা মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করবে, না তারা তাদের ভর্তি করবে মাত্র, পড়ে শুনে বুঝে লিখে পাস করা মাতৃভাষার কোল থেকে বেরোনো ছাত্রছাত্রীদের দায়, লরেটোর নয় ?

৩. তিনি মেয়েদের স্কুলও খুলেছেন ১৮৪৭-এ, অর্থাৎ কলকাতায় বেথুন স্কুল বা বারাসতে প্যারীচরণ সরকারের আগে। আমরা অনেকেই এ খবর জানি না।

৪. শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষা কথাটা নানা বিভ্রান্তিতে ভর্তি। আমাদের মনীষীরা আর শিক্ষনীতির প্রণেতারা এই বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। এটা তাঁদের দোষ নয, তাঁদের সময়ে ভাষাবিজ্ঞান তাঁদের হাতে এ বিষয়ে এখনকার সিদ্ধান্তগুলি তুলে দিতে পারেনি। আসল কথা হল, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুর মাতৃভাষা তার শিক্ষার ভাষা নয়। একটা ভাষার মধ্যে আসলে অনেক ধরনের ভাষা থাকে। নানা জায়গার উপভাষা থাকে, শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের ভাষা থাকে ; সবার উপরে থাকে একটা মান্য বা স্ট্যান্ডার্ড ভাষা। সেটাই ওই ভাষার শিশুর শিক্ষার ভাষা। স্কুলে আসতে হলে শিশুকে তার ঘরের ভাষা (যা মোটামুটিভাবে তার ‘মাতৃভাষা) থেকে বেরিয়ে ওই মান্য ভাষায় পৌঁছোতে হয়। তা বলতে আর লিখতে শিখতে হয়। তার আসল মাতৃভাষায় তার শিক্ষার, অর্থাৎ স্কুলকলেজে শিক্ষার কাজ হয় না। এই জন্য বর্তমান লেখক কিছুদিন হল ‘শি-মাতৃভাষা’ বা শিক্ষার মাতৃভাষা কথাটি ব্যবহার করছে।

আগের পর্বের লিঙ্ক- https://bangalinama.com/banglabhasha-pabitro-sarkar-part-3/


Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *