দিদার ডায়েরি (পর্ব ১)

দিদার ডায়েরি (পর্ব ১)
Spread the love

৬২ বছর আগেই একা কেদার-বদ্রি ঘুরে এসেছিলেন দিদিমা। সেই ডায়েরি এবার বাঙালিনামায় ধারাবাহিক লেখায়। লিখছেন – নাতনি মধুমিতা গুপ্ত বর্ধন।

আজকাল অনেক মেয়েই একা বা দল বেঁধে বেড়াতে বেরিয়ে পড়েন l কারও নিরাপত্তার ঘেরাটোপে নয়, নিজেরাই স্বনির্ভর হয়ে ঘুরে দেখতে চান এই বিরাট পৃথিবীর নানান জায়গা l একক ভ্রমণ হয়ে ওঠে তাঁদের স্বাধীনতা ও আত্মবিশ্বাসের উদযাপন l একেবারেই সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে এই প্রবণতা অনেকটাই হালফিলের l আজ থেকে তিন চার দশক আগেও আমরা যদি ভাবতে চাইতাম যে একজন মধ্যবিত্ত বৃদ্ধা একাই সঙ্গীসাথী জুটিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে পড়েছেন, ঠিক যেন বিশ্বাস হতো না, তাই না? এই অবিশ্বাস্য ঘটনাই আজ থেকে ৬২ বছর আগে ঘটিয়েছিলেন আমার দিদিমা স্বর্গতা সুবাসিনী গুহ l আর যে সে জায়গা নয়; একেবারে কেদার-বদ্রি ভ্রমণ l সেই গল্পই আপনাদের শোনাবো।

তবে গল্পে যাওয়ার আগে আমার দিদিমার সঙ্গে আপনাদের আলাপ করিয়ে দিই l সুবাসিনী বোসের জন্ম আনুমানিক ১৯০৬ সালে । তাঁর ছোটবেলা কেটেছে এদেশের অসমে আর বাংলাদেশের রাজশাহী ও ঢাকায় । বাবা ছিলেন ব্রিটিশ রাজত্বের জেলার। তাঁরই উৎসাহে সুবাসিনী চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পেরেছিলেন। মাত্র নয় বৎসর বয়সে বরিশালের অভয়নীল গ্রামের বীরেশ গুহর সাথে সুবাসিনীর বিয়ে হয়ে যায় l বিয়ের পর সুবাসিনী কিছুদিন শ্বশুরবাড়ি বরিশালে থেকে পরে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে আসেন l আলাদা করে তাঁর আর পড়াশোনা শুরু করা হয়নি । তবে সাধারণ গৃহবধূ হয়েও তাঁর পড়াশোনার প্রতি টান ছিল আজীবন । দুই মেয়েকে বেথুন কলেজ থেকে পাশ করিয়ে তবেই উনি বিয়ের পিঁড়িতে বসান। মাত্র ৪৬ বছর বয়সে সুবাসিনী বিধবা হন । ছোট মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে তিনি সঙ্গীসাথী জোগাড় করে নিয়মিত তীর্থভ্রমণে যেতেন l এই বেড়ানোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তিনি লিখে রেখে যান l

গতবছর সেপ্টেম্বর মাসেই আমি নিজেও কেদার-বদ্রি যাত্রা সম্পন্ন করে ফিরেছি l আমরা প্রতি বছর এই সময় তিন-চারটি ভ্রমণপিপাসু পরিবার ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে বেরিয়ে পড়ি l পথ যেন আমাদের নিশির মতো ডাকে l এবারেও তার অন্যথা হয়নি l কিন্তু আমার নিজের মনের মধ্যে ওই বারের বেড়াতে যাবার অভিজ্ঞতা একেবারেই অন্য রকম l  তার কারণ একটা ছোট্ট লাল ডায়েরি, যেখানে আমার দিদিমা লিখে গিয়েছেন তাঁর কেদার-বদ্রি যাওয়ার বিবরণ l এ যেন আমার পূর্বসূরী অনন্যার দেখানো পথে নতুন করে নিজের পথ খুঁজে নেওয়া l বুঝতে পারি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক পরিবর্তন আর প্রযুক্তির উন্নতির হাত ধরে কতটা সহজ হয়ে উঠেছে আমাদের রোজকার জীবন ও চলাফেরা l আমাদের রুদ্রপ্রয়াগ থেকে কেদারনাথ যেতে লেগেছে তিন দিন, আর চোপ্তা থেকে বেরিয়ে বদ্রিনাথ দর্শন করেছি মাত্র দুদিনে l দিদিমার সেখানে রুদ্রপ্রয়াগ থেকে কেদারনাথ পৌঁছতেই লেগেছিলো সাত দিন l তাও সেটা তিনি পার করেছিলেন সেই সময়কার হিন্দু ঘরের বিধবার সব রীতিনীতি মেনে l সম্পূর্ণ নিরামিষ খাবার খেতেন, আর সূযাস্তের পর কখনো অন্ন গ্রহণ করতেন না l পরণে থাকতো সেমিজ আর কালো সরু পাড় ধুতি l

কেদার-বদ্রি ভ্রমণে দিদিমার সঙ্গে ছিল কন্যাসমা প্রতিবেশী নন্দা সিং ও তাঁর ভাই পুত্রসম পচা সিং l দিদিমা অবশ্য একটা আফসোস করতেন, সেটা হলো মন্দির খোলার দিনই উপস্থিত না থাকতে পারা l দিদিমার বয়ান অনুযায়ী “পচায় কইলো মাসিমা আমরা এমন ভাবে বাড়াইমু এক্কেরে যেন মন্দির খোলার প্রথম দিনেই পৌঁছাইয়া যাই l মন্দির প্রথম যেদিন খোলে সেদিন মন্দির গর্ভ থিক্যা এক অপূর্ব জ্যোতি বাইর হয়। আমরা সেইডা দেখনের সাক্ষী থাকুম l ছাই l আমরা বরফের মধ্যে হাঁচর পাঁচর কইরা যখন পৌঁছাইলাম তখন মন্দির তিন দিন হইলো খুইল্যা গ্যাসে l”

পরবর্তী গল্প আমি, মানে মধুমিতা আর বলবো না l  দিদিমা সুবাসিনীর ডায়েরি থেকেই তুলে দিচ্ছি তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত l ওঁর লেখার মধ্যে দিয়েই ফিরে চলুন ৬২ বছর আগের কেদার-বদ্রির রাস্তায়… (আসছে পরের পর্বে)।

দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্ক- https://bangalinama.com/kedar-bodri-diary-part-2/


Spread the love

1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *