লেখা ও ছবি – সোনালি পাল
খাদ্যরসিক কলকাতা। এখানকার অলিতে গলিতে রসনার বাস। সালদানহার কেক তার অন্যতম অঙ্গ। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই ঘরোয়া শিল্প মহিলারাই চালিয়ে আসছেন, এক-আধ বছর নয়, পাক্কা চার প্রজন্ম ধরে। ১৯৩০ সালে উবেলিনা সালদানহা ও তাঁর স্বামী ইগনেশিয়াসের হাত ধরে এই বেকারির যাত্রা শুরু। তখন অধিকাংশ মহিলা ঘরবন্দি থাকাটাই পছন্দ করতেন। কিন্তু উবেলিনা চেয়েছিলেন ঘেরাটোপের বাইরে এসে নতুন কিছু করতে। ফ্রুট কেক আর কেকানাট ম্যাকারুন- নানা বিশেষ আইটেম বাজারে নিয়ে আসেন তিনি। শুধু কি তাই? বাচ্চাদের রসনার কথা ভেবে তিনি সানলাইট বিস্কুট থেকে শুরু করে বাবা কেক বা
গোয়ান কেক সবই বাজারে এনেছিলেন।
উবেলিনার উত্তরাধিকার বহন করে নিয়ে যান তাঁর বৌমা মোনা সালদানহা ও তাঁর স্বামী ডেনজেল। ডেনজেল পেশায় ছিলেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। তাঁরা কোকোনাট ম্যাকারুনের তৈরির প্দ্ধতিতে আরও বদল আনেন। তাঁদের হাতেই তৈরি কলকাতাবাসীর প্রিয় ওয়ালনাট কেক। মোনা নিয়ে আসেন তাঁর নিজের নকশা দিয়ে তৈরি বিয়ের কেক।
মোনার পর তার কর্মযজ্ঞের দায়িত্ব নেন মোনার মেয়ে ডেবরা। তিনি পেশায় ছিলেন ব্যাঙ্ককর্মী। কিন্তু পরিবারের ঐতিহ্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি ব্যাঙ্কের কাজ ছেড়ে পুরোপুরি মন দেন এই বেকারিতেই। আর সালদানহার সুস্বাদু খাদ্যতালিকায় যোগ করেন প্যাটিস, কিসের মতো নানারকম নোনতা খাবার। আজকের দিনে সালদানহার সম্পূর্ণ দায়িত্বে আছেন ডেবরা আর তাঁর সুযোগ্য কন্যা আলিশা। আলিশা তাঁর পরিবার সূত্রে পাওয়া দক্ষতা আরও উন্নত ও সময়োপযোগী করার জন্য কাজ শিখে আসেন বেকিং দুনিয়ার পীঠস্থান লন্ডনের ‘ল্য কর্দন ব্লিউ’ থেকে। তিনি শুরু করেন নানারকম ফরাসি পেস্ট্রি, চিজ কেক ও বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি পছন্দসই কেক।
শুধু কর্ণধার হিসেবে মা-মেয়ের জুটি নয়, ছোট্ট অফিসের বেশিরভাগ ম্যানেজারও মহিলা। তাই সালদানহা প্রকৃত অর্থেই মহিলা পরিচালিত প্রতিষ্ঠান। এই বিরাট কর্মকাণ্ডের সবটাই চলে ওঁদের বাড়ির মধ্যে থেকে। প্রতিদিন ডেবরা ও আলিশা কাঁচামাল কেনা থেকে ডেলিভারি প্রতিটি কাজের দেখভাল করেন। ডেবরার বক্তব্য, “কোনও কিছুই হালকাভাবে নিয়ে একদিনের জন্যও ছেড়ে দিলে চলবে না। সবকিছু নিখুঁত ও সেরা হতে হবে। বংশপরম্পরায় আমরা নিজেদের ১০০ শতাংশ আবেগ আর দক্ষতা উজাড় করে চলেছি। আর নিখুঁত কারিগরির সঙ্গে ভালবাসার যথার্থ সংমিশ্রণ না হলে এই অনন্য স্বাদ তৈরি হয় না।“
পারিবারিকভাবে সবকিছু সামলানো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। আলিশা তো বলেই ফেললেন, ‘আমরা তো কখনওই পুরো পরিবার একসঙ্গে ছুটি নিতে পারি না।‘ সঙ্গে সঙ্গেই মা ডেবরা যোগ করেন, ‘ কিন্তু এই নিয়ে আমাদের কোনও আক্ষেপ নেই। আমরা সব জেনেবুঝে ভালবেসেই এই পথ বেছে নিয়েছি… পরিবারের ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য।“ উত্তরাধিকার বহন করে নিয়ে যাওয়ার দায়বদ্ধতা চোখে পড়ে সালদানহার সবকিছুতেই। উবেলিনা সালদানহা যে কাঠের চুল্লিতে কাজ শুরু করেছিলেন, আজ প্রায় ১০০ বছর পরও সেটাই ব্যবহৃত হচ্ছে। ওই প্রজ্জ্বলিত চুল্লির ওম এবং কেকের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে পরিবারের একাল থেকে সেকালে।
দেওয়ালে পূর্বপুরুষদের ছবি গর্ব আর নিশ্চিন্ততায় তাকিয়ে থাকে তাঁদের উত্তরসূরী মেয়েদের কৃতিত্বে।
মিষ্টি হেসে আলিশা বলেন, ‘এই বেকিংয়ের প্রতি ভালবাসা এবং নিজেদের মতো কিছু করার জেদ আমাদের পরিবারের মহিলাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত হয়েছে। এটা আমাদের জিনেই রয়েছে। ‘ তাহলে তো ধন্যবাদ জানাতেই হয় সেই জিনকে যা খাদ্যরসিক কলকাতার মানুষকে প্রায় এক শতাব্দী ধরে উপহার দিয়ে চলেছে স্মৃতিমেদুর স্বাদের জাদু।
খুব সুন্দর প্রতিবেদন । পারিবারিক ব্যবসা এরকম হয়তো আরো আছে । কিন্তু কোনো প্রচার নেই । নাহুম সবাই জানে কিন্তু সালদানহা কেক কজন জানে ? এরকম যাদের বেশি পরিচিতি নেই কিন্তু খুব ছোট স্কেলে সাফল্যের সাথে ব্যবসা করে যাচ্ছে ।তাদের সামনে আনতে পারলে খুব ভালো হয় ।