লিখেছেন সুস্মিতা গঙ্গোপাধ্যায়
গত ১২ ফেব্রুয়ারি ছিল ফুটবলার মোনেম মুন্নার মৃত্যুবার্ষিকী। সেদিন তাঁর সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে রীতিমতো আবেগপ্রবণ লাল হলুদ কর্তা দেবব্রত সরকার থেকে সেকালের বহু সমর্থক। মুন্না, রুমি ও আসলাম বাংলাদেশ থেকে খেলতে এসেছিলেন ইস্টবেঙ্গলে। তাঁদের খেলা আজও ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের মনে উজ্জ্বল। সবথেকে বড় কথা, তাঁরা যে বিদেশি হিসাবে এদেশে খেলে গেছেন, এটাও যেন মাথায় থাকত না সেসময়কার কর্তা বা সমর্থকদের। এর কারণটাও কিন্তু খুব অগ্রাহ্য করার মতো নয়। এক তো ভাষাটা এক। অর্থাৎ শুধু বাংলা নয়, যে ডায়ালেক্টে (যাকে এদেশে বাঙাল ভাষা বলা হয়) কথা বলতেন, মুন্নারা, সেটাতেই কথা বলেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত মানুষ। একইভাবে খাওয়া-দাওয়া, সংস্কৃতি সব এক। কিন্তু এটুকুতেই বাঁধা ছিল না এই দু’দেশের সম্পর্ক। রাজনীতিকে সরিয়ে রেখে শুধু খেলার মাঠের কথাই এক্ষেত্রে বলতে চাইছি। ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে নাহয় সব এক। কিন্তু সেসময় মোহনবাগান বা মহমেডান কর্তা, প্রয়াত অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিরা অহরহ ওঠাবসা করতেন বাংলাদেশের ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত লোকজনের সঙ্গে। ক্রিকেটাররা নিয়মিত খেলতে যেতেন। নইমুদ্দিনকে তো বহুকাল পর্যন্ত ওদেশে কোচিং করাতে আমি নিজেও দেখেছি। কিন্তু তাতে কখনও সমস্যা হয়েছে বলে শুনিনি। বরং দুটো আলাদা দেশ বলেও মনে হয়নি কারোর।
এবার কাট টু, চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি। ভারত-বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ মহিলা দলের সাফ কাপ ফাইনালকে ঘিরে ধুন্ধুমার ঢাকার কমলাপুর স্টেডিয়ামে। সেদিন এক হাস্যকর ঘটনার সাক্ষী থাকল গোটা বিশ্ব। ফাইনালে দু’দলের মহিলারা বা বলা ভালো কিশোরীরা অসাধারণ লড়াকু মেজাজ দেখালেন ম্যাচে। কিন্তু তাঁদের মাঠের এই যাবতীয় লড়াইয়ে জল ঢেলে দিলেন ম্যাচ অফিসিয়ালস ও কর্তারা। সঙ্গী হলেন গ্যালারির একদল উগ্র সমর্থক। ম্যাচ ড্র থাকার পর টাইব্রেকারেও ১১-১১ হয়ে যাওয়ায় রেফারি ফয়সালা করতে টস করেন। এটা করার সময়ে দিব্যি দু’দলই উপস্থিত থাকে। এমন নয় যে লুকিয়ে টস হয়। টস জিতে যাওয়ায় ভারতকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। এরপরই বদলে যায় পরিবেশ। হঠাৎই ফলাফলে আপত্তি জানিয়ে বেঁকে বসেন বাংলাদেশী মেয়েরা (সম্ভবত বাইরে থেকে আসা নির্দেশে)। দৌড়ে আসেন ম্যাচ কমিশনার। তিনিও জানান, এরকম কোনও নিয়ম
নেই। তাই আবার টাইব্রেকার শুরু করতে হবে। মজার কথা হচ্ছে, ম্যাচ কমিশনারের সঙ্গে কথা না বলে কোনও রেফারি একা সিদ্ধান্ত নেন না। আর তার থেকেও বড় কথা, যেকোনও সিদ্ধান্ত একবার নেওয়া হয়ে গেলে, সেটা ভুল হলেও বদল করা যায় না। অথচ সেই সময়ে গ্যালারি থেকে ভারতীয় কিশোরী মেয়েদের উদ্দেশে ‘চোর, বেইমান’ স্লোগান শুরু হওয়ায় দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে। ভারতও অনড় থাকে। শেষমেশ ভারতীয় হাই কমিশনার ও এআইএফএফ সভাপতি কল্যাণ চৌবের মধ্যস্থতায় যৌথ চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়। আরও আগে, গত অক্টোবর-নভেম্বরে ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময় কলকাতায় পাকিস্তান-বাংলাদেশ ম্যাচ। সেখানেও শেষদিকে পাকিস্তান যখন জিতছে তখন উচ্ছ্বাস ও হাততালির বন্যা দেখেছি ইডেন গার্ডেন্সে। যা দেখে এক বাংলাদেশী বন্ধু সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, পাকিস্তানের জন্য এত হাততালি কেন? ঠিক এই প্রশ্নটাই
আমারও ছিল ঢাকায় একবার এশিয়া কাপ করতে গিয়ে। মীরপুর স্টেডিয়াম সেদিন পাকিস্তানের পক্ষে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিল ভারতের হারে।
মুন্নাদের সময়কার পারস্পরিক সেই বাঁধন কবে যে এতটা শত্রুতায় বদলে গেল, তার হদিশই পাওয়া যায় না। যদি শুধু মাঠের লড়াই হয়, তাহলে এই আকচা-আকচি অবশ্যই ভাল নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু গ্যালারি যখন অন্যরকম আচরণ করে তখন কিন্তু প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। প্রশ্ন জাগে, শুধুই রাজনীতি বা ধর্মই কি এর কারণ? নাকি আরও কিছু আছে। ভাবতে থাকুন দুই বাংলার মানুষই। আমরা বরং সেই সৌহার্দ্যের সম্পর্ক ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখি ততদিন।