আমরা যেন বাংলাদেশের চোখের দুটি তারা

আমরা যেন বাংলাদেশের চোখের দুটি তারা
Spread the love

লিখেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক রন্তিদেব সেনগুপ্ত

উত্তর কলকাতার যে পাড়াটিতে আমার শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে, সেই পাড়ায় আমাদের বাড়িটির পরিচয় ছিল বাঙাল বাড়ি হিসেবে।  বাঙাল বাড়ি বললে একডাকে দেখিয়ে দিত সবাই।  আমাদের বাঙাল বাড়ির একান্নবর্তী পরিবারে সকাল হত সকলের সম্মিলিত হই হট্টগোলে। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অবধি সেই হট্টগোল চলতেই থাকত। আসলে আমাদের বাড়ির সকলে কথা বলত উচ্চস্বরে। হাসত আরও উচ্চস্বরে। এমনকি রাগের প্রকাশও হত পাড়া পড়শিকে জানান দিয়ে। আমার দাদু বলতেন , ” বুঝলি, যারা  জোরে কথা কয়, আর  হাসে , হেই হক্কলটির মন বড় সরল হয়।” হয় কি হয় না জানি না, তবে আমাদের বাঙাল বাড়িতে সারল্যের অভাব ছিল না। পরীক্ষায় অঙ্কে পঁয়ত্রিশ পেয়ে বাড়ি ফিরলেও পড়শিদের ডেকে আমার কাকারা জানিয়ে দিতেন , “হেইডার কিছু হইব না বুঝলেন। অঙ্কে পঁয়ত্রিশ পায়।” আমাদের এ হেন বাঙাল বাড়ির প্রসিদ্ধি ছিল দুটি কারণে। প্রথমত, পাড়ার সকলে বলত আমার ঠাকুমার মতো রান্নার হাত নাকি ও তল্লাটে আর কারো নেই। শুনে আমার ঠাকুমা প্রীত হতেন। ফলে,  রোজই পাড়ার কারো না কারো বাড়িতে আমাদের বাড়ি থেকে বাটি ভরতি  নানাবিধ সুখাদ্য যেত। সেসব যে খুব পোলাও – মাংস তা নয়।  হয়তো কোনোদিন কচুর শাক, কোনোদিন সরষে বাটা দিয়ে লাউশাক চচ্চড়ি, কোনোদিন বা ছোট ট্যাংরা মাছের ঝাল। আর একটা পদ মাঝেমধ্যে রান্না হত আমাদের বাড়িতে। শুঁটকি মাছ। তবে সেটা অবশ্য পাড়ার বিশেষ কেউ খেত না। যেদিন শুঁটকি মাছ রান্না হত , আমরা বাড়ির ছেলেবুড়োরা হামলে পড়ে চেটেপুটে খেতাম। আমার সেজোকাকার এক অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন — অমলকাকু। কৃষ্ণনগরের আদি বাসিন্দা। আমাদের বাড়ি শুঁটকি খেয়ে এমন শুঁটকিপ্রেমী হয়ে উঠেছিলেন যে, শুধু শুঁটকি মাছ খাওয়ার জন্যই  আমাদের বাড়িতে ছুটে আসতেন। দ্বিতীয়ত,  সর্বক্ষণ হই হট্টগোল করে চলা আমার বাঙাল কাকারা পাড়ার যে কোনো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। সে পাড়ার দুর্গা পুজো হোক   কারোর বাড়ি মেয়ের বিয়ে হোক , বা রাতবিরেতে কারোকে হাসপাতালে  নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনেই হোক। আমার দাদু বলতেন — ” বাঙালরা এমুনডাই ।”

আসলে আমরা ছিলাম গর্বিত বাঙাল।  আমাদের বাঙালত্ব নিয়ে আমরা গর্ব করতাম। আমার দাদু বলতেন , “আমরা ত ঢাকার মানুষ। ঢাকা ছাইড়া কলকাতা আইছি সইত্য,  তাইর লাইগ্যা কি ঢাকাটারে ছাড়তে পারি।” না, আমরা ঢাকাকে কখনো ছাড়তে পারিনি।  আমরা বরাবরই জেনেছি,  কলকাতা এবং ঢাকা দুটোই আমার।

আমার বাপ ঠাকুরদার বাড়ি ছিল ঢাকায়। ঠাকুমার বাপের বাড়ি ছিল নারা’ণগঞ্জে। আমার মা ছিলেন ময়মনসিংহের মেয়ে। দাদু আর বাবার কাছে শুনেছি, ঢাকার বলধা পাড়ায় আমাদের বাড়ি ছিল। সেখানে নাকি ছেলেদের একটি খেলার মাঠ ছিল । স্কুল জীবনে সেই মাঠে আমার বাবা হকি খেলতেন। আমার মা আঙ্গুটি আর পাঙ্গুটির কথা বলতেন। তারা ছিল মায়ের পোষা বিড়াল। ময়মনসিংহের বাড়িতে মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াত তারা।  আর বলতেন ব্রহ্মপুত্র নদের কথা। বালিকা বেলায় ছুটির দিন বাবার হাত ধরে ব্রহ্মপুত্র নদের ধারে বেড়াতে যেতেন আমার মা। 

এহেন বাঙাল বাড়ির সন্তান আমি প্রথম বাংলাদেশ যাই নয়ের দশকের গোড়ায়।  সেবার বাংলাদেশ যাওয়ার আগে আমার মিতভাষী এবং স্বভাব গম্ভীর বাবা আমাকে একান্তে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন , ” সময় পেলে একবার বলধা পাড়াটা ঘুরে এসো ।” আর মা বলেছিলেন , ” আমাদের ময়মনসিংটা একবার যাবি না ?” আমি বলধা পাড়াতে গিয়েছিলাম। ময়মনসিংহেও গিয়েছিলাম। বলধা পাড়ায় সেই ছেলেদের খেলার মাঠটা অবশ্য খুঁজে পাইনি। আর ময়মনসিংহে গিয়ে এক বিকেলে  অনেকক্ষণ চুপচাপ বসেছিলাম ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে।  এক বালিকা আর তার পিতাকে খুঁজেছিলাম। ওই তখনই আমি বুঝেছিলাম , আসলে নদী মাটি আকাশ এবং মনকে ভাগ করা যায় না। কাঁটাতারের বেড়া বসালেও নয়।

ভাগ করা যায়ওনি অবশ্য। সেটা পাঁচ-পাঁচবার বাংলাদেশ গিয়ে বুঝেছি আমি। প্রথমবার বাংলাদেশ গিয়ে আমার পরিচয় হয়েছিল মেজবাহ ভাইয়ের সঙ্গে।  সে বন্ধন এখনো অটুট। যশোরে আমাকে মাইকেল মধুসূদনের বাড়ি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল মেজবাহ ভাই। আমাদের দুজনেরই প্রিয় কবির তালিকায় রয়েছেন জীবনানন্দ, আল মাহমুদ , শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান। আমরা দুজনেই রবীন্দ্র গানে আপ্লুত হই।  মেজবাহ ভাইয়ের মেয়ে শিমুল রবীন্দ্র গান শিখেছে।  যতবার ঢাকায় গিয়েছি শিমুল গান শুনিয়ে মন ভরিয়ে দিয়েছে আমার। মেজবাহ ভাইয়ের স্ত্রী,  আমাদের রোশেনারা ভাবী ঢাকায় থাকার দিনগুলিতে আমাকে কখনো হোটেলে খেতে দেননি।  রোজই বাড়িতে নিজের হাতে রান্না করে নিত্যনতুন পদ খাইয়েছেন তিনি।

কী করে ভুলি নাটোর থেকে ঢাকা আসার পথে হাইওয়ের ধারে সেই ছোট্ট মিষ্টির দোকানির কথা। যিনি কলকাতা থেকে আসছি শুনে মিষ্টির দাম নেননি আমার থেকে।  বলেছিলেন , ” আপনে ত ঘরে ফিইরা আসছেন। আপনের থেইক্যা কি দাম লওন যায়। ” কী করে ভুলে যাব রাজশাহীর সেই স্কুল টিচারের কথা, যিনি গ্রীষ্মের দুপুরে নিতান্তই অপরিচিত আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে বসিয়েছিলেন। বলেছিলেন -” এই গরমে ঘুইরেন না।  শরীরডা খারাপ হইব। আমার বাসায় বসেন। রোদ কমলে বাইরইবেন।” দুপুরবেলা মাছ ভাত খাইয়ে বিকেলের রোদ কমে এলে তবে ছেড়েছিলেন আমাকে । কী করেই বা ভুলি একুশের বইমেলায় দেখা হওয়া সেই মেয়েটিকে।  যে তার লেখা একটি চটি কবিতার বই  আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল ,” এই কবিতাই যেন বাইন্ধা রাখে দুই বাংলারে ।” জল ,মাটি, আকাশ ,নদী ,মনকে আলাদা করা যায়নি। যায়ও না ।

পাঁচ-পাঁচবার বাংলাদেশ গিয়েছি আমি।  প্রতিবারই নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। বন্ধুত্ব হয়েছে।  নতুন বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি।   কলকাতা যেমন আমার , ঢাকাও তেমনই  ক্রমশ আমার হয়েছে।  প্রতিবারই ঢাকা থেকে ফেরার সময় এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে এসে মেজবাহ ভাই জিজ্ঞাসা করেছে , ” আবার কবে আসবা?” শেষ বাংলাদেশ গিয়েছিলাম চারবছর আগে। তার ঠিক পরপরই  কোভিড এসে তছনছ করে দিয়ে গিয়েছিল আমাদের জীবন। সেবারও বিদায় জানাতে এসে মেজবাহ ভাই আকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল — ” কবে আসবা আবার ?” বলেছিলাম — “খুব তাড়াতাড়ি আসুম। দেইখ্যা নিও। ” যেতে পারিনি আমি।  শুধু ফোনে মেজবাহ ভাই কোভিডে আক্রান্ত হয়ে রোশেনারা ভাবীর চলে যাওয়ার খবরটি শুনিয়েছিল।

এ বছর আমি ফিরে যেতে পারিনি মেজবাহর কাছে। হয়তো সামনের বছরও পারব না। কিন্তু তার পরের বছর ফিরে যাব। নিশ্চয়ই যাব।


Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *